শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণ (Recurrent Infections in Children) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শিশু নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, যেমন ঠান্ডা, কাশি, ফ্লু, কান বা গলা সংক্রমণ ইত্যাদি। শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণ হতে পারে শারীরিক বা পরিবেশগত কারণে, এবং এর পেছনে কিছু সাধারণ কারণও থাকতে পারে।
শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণের কারণ:
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম (Immunodeficiency): শিশুদের ইমিউন সিস্টেম যদি দুর্বল হয়, তবে তাদের শরীর সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় না। কিছু শিশুর জন্মগতভাবে দুর্বল ইমিউন সিস্টেম থাকতে পারে অথবা কোনো অসুস্থতা যেমন HIV বা অন্যান্য রোগের কারণে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হতে পারে।
- পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব: সঠিক পুষ্টির অভাবে শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। বিশেষ করে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এবং আয়রন এর অভাব সংক্রমণ প্রতিরোধে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
- পরিবেশগত ফ্যাক্টর: গাদাগাদি, অপরিষ্কার পরিবেশ, বা শিশুর যাদের সর্দি-কাশি বা ইনফেকশন রয়েছে তাদের কাছাকাছি থাকা, এগুলি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। শিশুর স্কুল বা daycare centers-এর মতো জায়গাগুলোতে সহজেই বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
- অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারের পরিণতি: অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা (antibiotic resistance) তৈরি হতে পারে, যা ভবিষ্যতে সংক্রমণকে আরো জটিল করে তুলতে পারে।
- চিকিৎসা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি: কিছু শিশুর যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকে, যেমন অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, বা সিস্টিক ফাইব্রোসিস, তাহলে তাদের বারবার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
- ধূমপান বা দূষিত পরিবেশ: যদি শিশুর পরিবারে কেউ ধূমপান করে বা সে দূষিত পরিবেশে থাকে, তাহলে তার শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণের লক্ষণ:
- শরীরের তাপমাত্রা (জ্বর): বারবার জ্বর দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত শ্বাসনালী, কান, গলা, বা পেটের সংক্রমণ থেকে হয়।
- গলা, কান বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: ঠান্ডা লাগা, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট, এবং কান ব্যথা বা কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
- অধিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা: শিশু যদি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে তার শরীরে শক্তির অভাব হতে পারে, সে বেশি ক্লান্ত বা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
- অস্বাভাবিক খাওয়ার অভ্যাস: কিছু সংক্রমণের ফলে শিশু খেতে বা পান করতে অসুবিধা হতে পারে, এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী বা পুনরাবৃত্তি সংক্রমণ: একাধিক সংক্রমণ, যেমন ঠান্ডা বা গলা ব্যথা, বারবার ফিরে আসতে পারে এবং দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে।
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা: পেটের সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যেমন ডায়রিয়া বা বমি, যা একাধিকবার হতে পারে।
শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণের প্রতিকার:
- ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা:
- সঠিক পুষ্টি: শিশুকে সুষম খাদ্য প্রদান করা, যা ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন ও ফাইবারে সমৃদ্ধ।
- ভ্যাকসিন: শিশুদের নিয়মিত টিকা দেওয়া, যেমন ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস, নিউমোকোক্কাল, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও ইত্যাদি টিকা।
- পর্যাপ্ত ঘুম: শিশুদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন, যা তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- শরীরচর্চা: শিশুকে নিয়মিত শারীরিক কসরত করানো, যা তার ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
- শুদ্ধ পরিবেশ বজায় রাখা:
- শিশুদের থাকবার পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা, যাতে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে।
- শিশুর হাতে নিয়মিত সাবান দিয়ে ধোয়া এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখা।
- অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কতা: অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া পরিহার করা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ নেওয়া উচিত নয়। অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
- হাত ধোয়ার অভ্যাস: শিশুদের হাত ধোয়ার অভ্যাস শেখানো, বিশেষ করে খাওয়ার আগে বা টয়লেট ব্যবহারের পর।
- মুখে মাস্ক ব্যবহার: যদি শিশুর চারপাশে অন্য কোনো অসুস্থতা থাকে, তাহলে শিশুকে মাস্ক পরাতে সাহায্য করতে পারে যাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ: যদি শিশুর বারবার সংক্রমণ হয় এবং এর পেছনে কোনো গুরুতর সমস্যা সন্দেহ করা হয়, তাহলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কখনও কখনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যেমন পেডিয়াট্রিক ইমিউনোলজিস্ট, সাহায্য করতে পারেন।
শেষ কথা:
শিশুদের মধ্যে বারবার সংক্রমণ একটি উদ্বেগের বিষয় হতে পারে, তবে এটি অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য। যদি শিশু নিয়মিতভাবে সংক্রমণের শিকার হয়, তবে পরিবারের সদস্যদের উচিত শিশুর সঠিক যত্ন নেয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।