মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচন (Spinal Nerve Compression) হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে মেরুদণ্ডের স্নায়ুগুলোর উপর চাপ পড়ে, যার ফলে স্নায়ু সংকুচিত হয়ে ব্যথা, অবশ ভাব বা অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত মেরুদণ্ডের ডিস্ক, হাড় বা লিগামেন্টের কারণে স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলস্বরূপ ঘটে।
কারণ:
মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচনের কিছু প্রধান কারণ হল:
- হেরনিয়েটেড ডিস্ক (Herniated Disc):
- মেরুদণ্ডের ডিস্কের ভেতরের অংশ বের হয়ে গিয়ে স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে স্নায়ু সংকোচন হয় এবং ব্যথা সৃষ্টি হয়।
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis):
- মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলিতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলে হাড়ের বৃদ্ধি, গিঁট বা অন্যান্য পরিবর্তন স্নায়ুর উপর চাপ ফেলতে পারে।
- স্কোলিওসিস (Scoliosis):
- মেরুদণ্ডের বাঁক পরিবর্তিত হলে স্নায়ু সংকুচিত হয়ে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
- লিগামেন্ট বা হাড়ের বৃদ্ধি (Bone Spurs or Ligament Thickening):
- মেরুদণ্ডের হাড়ে বৃদ্ধি (বোন স্পার) বা লিগামেন্টের পুরুত্ব বাড়ানো স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- মেরুদণ্ডের কনুস (Spinal Stenosis):
- মেরুদণ্ডের মধ্যে স্থান সংকীর্ণ হয়ে গেলে, স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হয়, যা স্নায়ু সংকোচন ঘটাতে পারে।
- পুনরাবৃত্তি বা অতিরিক্ত পরিশ্রম (Repetitive Stress or Overuse):
- বেশি পরিশ্রম বা একই অবস্থানে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে স্নায়ু চাপের মধ্যে আসতে পারে।
- আঘাত বা ট্রমা (Injury or Trauma):
- সোজা দুর্ঘটনা বা আঘাতের ফলে মেরুদণ্ডের হাড় বা ডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্নায়ুতে চাপ পড়তে পারে।
- প্রেগন্যান্সি (Pregnancy):
- গর্ভাবস্থায় শরীরের ভারসাম্য পরিবর্তন হওয়ায় পিঠের স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
- অতিরিক্ত ওজন (Obesity):
- অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং স্নায়ু সংকোচনের সম্ভাবনা বাড়ায়।
লক্ষণ:
মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচন সাধারণত বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে আসে, যার মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
- পিঠে বা ঘাড়ে ব্যথা:
- স্নায়ু সংকোচনের কারণে পিঠের বা ঘাড়ের কোনো অংশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- পায়ে শিরশির বা অবশ হওয়া:
- স্নায়ু সংকোচনের কারণে পায়ে শিরশির বা অবশ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
- হাঁটতে বা দাঁড়াতে অসুবিধা:
- স্নায়ু চাপের কারণে হাঁটা বা দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে। এটি পায়ের শক্তি কমিয়ে দিতে পারে।
- হাতে বা পায়ে দুর্বলতা:
- স্নায়ু সংকোচনের কারণে হাত বা পায়ে দুর্বলতা বা শক্তিহীনতা অনুভূত হতে পারে।
- গোড়ালি বা পায়ের নিচের অংশে ব্যথা:
- স্নায়ু সংকোচন পায়ের নিচের দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যানেস্টেসিয়া বা অনুভূতি হারানো (Numbness):
- স্নায়ু চাপের কারণে হাত বা পায়ে অনুভূতি হারাতে পারে, অর্থাৎ স্নায়ুতে সমস্যা হলে সাধারণত ওই অংশে অ্যানেস্টেসিয়া হতে পারে।
- সিঙ্গল সাইডে ব্যথা (Unilateral Pain):
- এক পাশের পিঠ বা পায়ের দিকে ব্যথা বা শিরশির অনুভূতি হতে পারে।
- মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারানো:
- স্নায়ু সংকোচনের কারণে কখনো কখনো ভারসাম্য হারানোর অনুভূতি হতে পারে।
প্রতিকার:
মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচন দূর করতে কিছু চিকিৎসা এবং প্রতিকার রয়েছে:
- বিশ্রাম (Rest):
- স্নায়ু চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ সময় এক জায়গায় শুয়ে না থেকে মাঝে মাঝে হালকা হাঁটাচলা করা উচিত।
- গরম এবং ঠাণ্ডা সেঁক (Hot and Cold Therapy):
- গরম সেঁক মাংসপেশী শিথিল করতে সাহায্য করে, আর ঠাণ্ডা সেঁক প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যথানাশক ওষুধ (Pain Relievers):
- প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক ওষুধ স্নায়ু সংকোচনের ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ফিজিক্যাল থেরাপি (Physical Therapy):
- বিশেষ ব্যায়াম এবং ম্যানুয়াল থেরাপি স্নায়ু চাপ কমাতে এবং মেরুদণ্ডের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
- পোস্টেরাল কোরেকশন (Postural Correction):
- সঠিক ভঙ্গিতে বসা, দাঁড়ানো এবং হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের সঠিক অবস্থান মেনে চললে স্নায়ুতে চাপ কমতে পারে।
- স্ট্রেস কমানো (Stress Reduction):
- মানসিক চাপ কমানো এবং যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা শিথিলকরণ কৌশলগুলি ব্যবহার করলে স্নায়ু চাপের প্রভাব কমানো যায়।
- চিরোপ্র্যাকটিক কেয়ার (Chiropractic Care):
- চিরোপ্র্যাকটিক চিকিৎসা মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচন কমাতে সহায়ক হতে পারে। এটি মেরুদণ্ডের সঠিক স্থিতি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
- স্টেরয়েড ইনজেকশন (Steroid Injections):
- মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচনের জন্য স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যথা কমাতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
- অপারেশন (Surgery):
- যদি ডিস্ক বা মেরুদণ্ডের অস্থিরতা বেশি হয়, এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর না হয়, তবে অস্ত্রোপচার হতে পারে। অপারেশন করে স্নায়ু চাপ কমানো যায়।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
- যদি ব্যথা এবং অন্যান্য লক্ষণগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- যদি পা বা হাতের শক্তি হারিয়ে যায় বা অবশ হয়ে যায়।
- যদি মূত্র বা পায়খানার সমস্যা দেখা দেয়।
- যদি হাঁটতে বা দাঁড়াতে সমস্যা হয়।
- যদি ব্যথার সাথে জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো গুরুতর লক্ষণ থাকে।
মেরুদণ্ডের স্নায়ু সংকোচন সাধারণত চিকিৎসা বা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে ভালো হতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলা উচিত।