মস্তিষ্ক ঝিল্লী প্রদাহ (Meningitis) হলো মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ডী তারকার চারপাশে থাকা মস্তিষ্কের ঝিল্লী (meninges) এর প্রদাহ। এটি একটি গুরুতর শারীরিক অবস্থা যা দ্রুত চিকিৎসা না দিলে জীবন বিপদে ফেলতে পারে। মেনিনজাইটিস সাধারণত ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ফাঙ্গাল বা পারাসাইটিক ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে।
১. মস্তিষ্ক ঝিল্লী প্রদাহের কারণ:
মেনিনজাইটিসের কারণ হিসেবে প্রধানত নিম্নলিখিত ইনফেকশনগুলো দায়ী:
- ভাইরাল ইনফেকশন (Viral Infection):
- ভাইরাল মেনিনজাইটিস সবচেয়ে সাধারণ ধরনের। এটি সাধারণত হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (HFMD) বা চিকেনপক্স (Chickenpox) বা মাম্পস (Mumps) ভাইরাস দ্বারা হতে পারে।
- হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (Herpes Simplex Virus) বা এনসেফালাইটিস (Encephalitis) ভাইরাসও মেনিনজাইটিস সৃষ্টি করতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন (Bacterial Infection):
- নেইসেরিয়া মেনিংটিডিস (Neisseria meningitidis): এটি ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ কারণ।
- স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus pneumoniae) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (Haemophilus influenzae) এছাড়া মেনিনজাইটিসের কারণ হতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস খুবই গুরুতর এবং দ্রুত চিকিৎসা না হলে প্রাণঘাতী হতে পারে।
- ফাঙ্গাল ইনফেকশন (Fungal Infection):
- ক্রিপটোকক্কাস (Cryptococcus) নামক ফাঙ্গাসের কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে, তবে এটি সাধারণত দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা (কম ইমিউন সিস্টেম) থাকা মানুষের মধ্যে ঘটে।
- পারাসাইটিক ইনফেকশন (Parasitic Infection):
- কিছু পারাসাইট, যেমন টক্সোপ্লাজমা (Toxoplasma), মেনিনজাইটিসের সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি বেশিরভাগই ইমিউন সিস্টেম দুর্বল ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
- অটোমিউন ডিসঅর্ডার (Autoimmune Disorders):
- কিছু অটোইমিউন রোগ (যেমন লুপাস) এর ফলে মস্তিষ্কের ঝিল্লীতে প্রদাহ হতে পারে।
- ট্রমা বা আঘাত (Trauma or Injury):
- মস্তিষ্ক বা মাথার উপর আঘাত (যেমন দুর্ঘটনা, মাথায় আঘাত) মেনিনজাইটিসের কারণ হতে পারে, কারণ এর ফলে ইনফেকশনের প্রবাহ ঘটতে পারে।
২. মস্তিষ্ক ঝিল্লী প্রদাহের লক্ষণ:
মেনিনজাইটিসের লক্ষণ বেশ দ্রুত প্রকাশ পায় এবং সাধারণত এটি বেশ তীব্র হয়ে থাকে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- উচ্চ জ্বর (High Fever):
- মেনিনজাইটিসের প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর।
- মাথাব্যথা (Severe Headache):
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা হতে পারে, যা সাধারণ মাথাব্যথা থেকে অনেক বেশি তীব্র এবং স্থায়ী হতে পারে।
- কাঁপুনি (Chills):
- শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে পারে এবং এর সাথে কাঁপুনি হতে পারে।
- মাথা ঘোরানো ও অস্বস্তি (Dizziness and Confusion):
- মাথা ঘোরানো, বেহুঁশ হওয়া, বা বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।
- ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া (Stiff Neck):
- ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে মাথা সামনে বা পিছনে ঝোঁকা কঠিন হতে পারে। এটি মেনিনজাইটিসের একটি অন্যতম লক্ষণ।
- আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা (Sensitivity to Light):
- আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বা ফটোফোবিয়া (Photophobia) হতে পারে।
- বমি বমি ভাব বা বমি (Nausea and Vomiting):
- মেনিনজাইটিসের কারণে বমি হতে পারে, বিশেষত তীব্র মাথাব্যথার সাথে।
- কনফিউশন বা আচরণের পরিবর্তন (Confusion or Behavioral Changes):
- মানুষ আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন অনুভব করতে পারে, যেমন বিভ্রান্তি, মনের অস্পষ্টতা, বা অস্বাভাবিক আচরণ।
- বাচ্চাদের জন্য বিশেষ লক্ষণ:
- বাচ্চাদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের লক্ষণ হিসেবে তীব্র কান্না, খাবারে অস্বীকার, ঘাড় শক্ত হওয়া বা শরীরের অস্বস্তি দেখা দিতে পারে।
- নবজাতকদের মধ্যে Fontanel (মাথার কোমল স্থান) ফুলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
৩. মস্তিষ্ক ঝিল্লী প্রদাহের প্রতিকার:
মেনিনজাইটিস একটি জীবনঘাতী অবস্থা হতে পারে, তাই এটি নিরাময়ের জন্য দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরনের উপর, তবে নিচে কিছু সাধারণ প্রতিকার উল্লেখ করা হলো:
(i) ভাইরাল মেনিনজাইটিস:
- বিশ্রাম: রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া উচিত।
- অ্যানালজেসিক (Pain Relief): জ্বর এবং মাথাব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল বা ইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ভাইরাল মেনিনজাইটিসের জন্য সাধারণত অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
(ii) ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস:
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা: ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস দ্রুত চিকিৎসা না হলে প্রাণঘাতী হতে পারে। এজন্য অ্যান্টিবায়োটিক (বিশেষ করে ইনট্রাভেনাস) দেওয়া হয়।
(iii) ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিস:
- অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা: ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিসে বিশেষ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দেওয়া হয়, যা ইনফেকশন নিরাময়ে সহায়তা করে।
(iv) পুনরুদ্ধার বা পুনর্বাসন:
- নিউরোলজিক্যাল থেরাপি: মেনিনজাইটিস থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু রোগীকে ফিজিওথেরাপি বা নিউরোলজিক্যাল থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে যদি মস্তিষ্কের কিছু কার্যক্রমে ক্ষতি হয়ে থাকে।
(v) ভ্যাকসিনেশন:
- ভ্যাকসিন: কিছু ধরনের মেনিনজাইটিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। যেমন:
- মেনিংকোক্কাল ভ্যাকসিন (Meningococcal vaccine): এটি নেইসেরিয়া মেনিংটিডিস (Neisseria meningitidis) থেকে প্রতিরোধ করে।
- পানমোকোক্কাল ভ্যাকসিন (Pneumococcal vaccine): স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus pneumoniae) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন (Haemophilus influenzae type b vaccine): এই ভ্যাকসিনটি শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার:
মেনিনজাইটিস একটি গুরুতর এবং জীবনমৃত্যুর সমস্যা হতে পারে, তাই তার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াল, ফাঙ্গাল বা অন্যান্য কারণে এটি ঘটতে পারে এবং প্রতিটি ধরনের জন্য আলাদা চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সঠিক চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনেশন এর মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Top of Form