প্রসবান্তে শিশু স্তনদুধ না খেলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা মা এবং শিশুর মধ্যে সঠিক পুষ্টির অভাব সৃষ্টি করতে পারে। স্তনদুধ শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুর প্রথম পুষ্টিকর খাবার এবং এর মাধ্যমে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণ সরবরাহ হয়। যদি শিশুর স্তনদুধ খাওয়ার সমস্যা থাকে, তবে এটি মা এবং শিশুর জন্য একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রসবান্তে শিশু স্তনদুধ না খাওয়ার কারণ:
- শিশুর স্তনপান করার সমস্যা (Latch issues):
- কিছু শিশু জন্মের পর প্রথম দিনগুলিতে স্তনপান করতে অসুবিধা অনুভব করতে পারে। এই সমস্যা মূলত শিশু এবং মায়ের স্তনের সঠিক অবস্থান (ল্যাচ) না হওয়ার কারণে হয়, যার ফলে শিশুর জন্য স্তনপান করা কঠিন হতে পারে।
- দুধের অভাব বা কম দুধের উৎপাদন:
- কিছু মায়েদের প্রথমে পর্যাপ্ত দুধ উৎপন্ন হতে পারে না, যার ফলে শিশু যথাযথভাবে স্তনদুধ পান করতে পারে না। এটি হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, স্তনদুধ উৎপাদনে বিলম্ব অথবা মায়ের শারীরিক অবস্থা বা স্ট্রেসের কারণে হতে পারে।
- শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা:
- কিছু শিশু জন্মের সময় বা পরে কিছু শারীরিক সমস্যা (যেমন, ঠান্ডা, জন্ডিস, ঠোঁটের বা মুখের সমস্যা, জন্মগত সমস্যা) থাকতে পারে, যা তাদের স্তনপান করতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- পেডিয়াট্রিক সমস্যা (গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল বা শ্বাসকষ্ট):
- শিশুদের গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল সমস্যা বা শ্বাসকষ্টের কারণে তারা স্তনদুধ খেতে পারে না। এছাড়া, যদি শিশুর শরীরে কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি থাকে, তবে এটি তাদের খাওয়ার ইচ্ছা কমিয়ে দিতে পারে।
- মায়ের উদ্বেগ ও মানসিক চাপ:
- মায়ের মানসিক চাপ, উদ্বেগ, স্ট্রেস বা অবসাদ শিশুর স্তনপান করার পরিমাণে প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি মায়ের উদ্বেগ শিশুর জন্য স্তনদুধ খাওয়ার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- বিপরীত বা বিকৃত স্তন (Nipple issues):
- কিছু মায়ের স্তনপিপা ফাটল, আঘাত বা বিকৃত হতে পারে, যা শিশুকে স্তনপান করতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- অতিরিক্ত টপ–ফিডিং বা বোতল দিয়ে দুধ খাওয়ানো:
- যদি শিশুকে খুব তাড়াতাড়ি বোতল দিয়ে দুধ খাওয়ানো হয়, তবে সে স্তনপান থেকে বিরত হতে পারে, কারণ বোতল সহজে খাওয়া যায় এবং শিশুর জন্য এটি আরামদায়ক হতে পারে।
শিশুর স্তনদুধ না খাওয়ার লক্ষণ:
- শিশুর ক্ষুধার অনুভূতির অভাব:
- শিশুর ঘুমানোর সময়ে দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমানো, খাদ্য গ্রহণের প্রতি অনীহা বা অসন্তুষ্ট হওয়া লক্ষণ হতে পারে।
- চোখে অস্থিরতা বা কান্না:
- শিশুর স্তনদুধ না খাওয়ার সময়ে অস্থিরতা এবং অতিরিক্ত কান্না হতে পারে, বিশেষ করে যখন শিশুর ক্ষুধা মেটানো হয় না।
- খাওয়ার ইচ্ছার অভাব:
- শিশু যদি বারবার স্তন না নেয় বা দুধ খাওয়ার জন্য মুখ খুলতে না চায়, তবে এটি স্তনদুধ না খাওয়ার একটি লক্ষণ হতে পারে।
- শিশুর ওজন বৃদ্ধি না হওয়া:
- যদি শিশুর ওজন না বাড়ে বা যথেষ্ট পুষ্টি না পায়, তবে এটি স্তনদুধের অভাবের বা খাওয়ার সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
- নিরাপত্তাহীনতা বা অস্বস্তি:
- শিশু যদি স্তনপান করার সময় বিরক্ত বা অস্বস্তি অনুভব করে, এটি স্তনদুধ খাওয়ার সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।
শিশুর স্তনদুধ না খাওয়ার প্রতিকার:
- স্তনের সঠিক অবস্থান (Latch) ঠিক করা:
- স্তনপান করার সময় শিশুকে সঠিকভাবে স্তনে লাগানো (ল্যাচ) নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা এবং শিশু যদি একে অপরকে সঠিকভাবে ধরে না নেয়, তবে এটি শিশুর জন্য স্তনদুধ খাওয়ায় অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। মা বা পেডিয়াট্রিশিয়ান শিশুকে সঠিকভাবে স্তনদুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিতে পারে।
- দুধের উৎপাদন বাড়ানো:
- মায়ের দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য, জলপান এবং স্তনদুধ সঠিকভাবে খাওয়ানো নিশ্চিত করা উচিত।
- শিশুকে নিয়মিত স্তনপান করানো, এবং মায়ের দুধ জমে গেলে তা দ্রুত খালি করা সহায়ক হতে পারে।
- শিশুকে বোতল না দেওয়া:
- সম্ভব হলে প্রথম কয়েক সপ্তাহে শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত। যদি শিশুকে বোতল দেওয়া হয়, তবে এটি শিশুর জন্য স্তনপান করা বন্ধ করে দিতে পারে। শিশুকে বোতল দেওয়ার আগে স্তনদুধ খাওয়ার অভ্যাস স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- শিশুর স্বাস্থ্যের চিকিৎসা:
- যদি শিশুর স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে (যেমন ঠান্ডা, জন্ডিস, মুখের বা ঠোঁটের সমস্যা), তবে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। সঠিক চিকিৎসা শিশুকে স্তনদুধ খেতে সাহায্য করবে।
- স্তনের যত্ন নেওয়া:
- যদি স্তনে ফাটল বা আঘাত থাকে, তবে তা দ্রুত চিকিৎসা করা উচিত। কিছু প্রাকৃতিক উপাদান (যেমন, স্তনে মধু লাগানো) বা হালকা মাসাজ করার মাধ্যমে স্তন শুশ্রূষা করা যেতে পারে।
- স্তনপানকে আনন্দময় করা:
- মা এবং শিশুর মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য স্তনপানকে একটি আনন্দময় অভিজ্ঞতা হিসাবে গড়ে তুলুন। এই সময় শিশু যদি আরামদায়ক পরিবেশে থাকে, তবে স্তনপান করার প্রবণতা বাড়বে।
- মনোবল বাড়ানো:
- মায়ের মানসিক অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাকে যাতে মানসিক চাপ না হয়, সে জন্য তার পাশে থাকা, এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার জন্য সঠিক পরামর্শ দেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং বা সমর্থন গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
উপসংহার:
শিশুর স্তনদুধ না খাওয়ার সমস্যাটি কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ হতে পারে, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মনোযোগ দেওয়া গেলে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।