প্রসবান্তিক ব্যথাভ্যাদাল ব্যথা (Postpartum Perineal Pain or Postpartum Pelvic Pain) হলো প্রসবের পর একটি সাধারণ সমস্যা, যেখানে মায়ের পারিনিয়াল (যৌনাঙ্গের আশপাশের) বা পেলোভিক এলাকায় ব্যথা অনুভূত হয়। এটি সাধারণত প্রাকৃতিক জন্মের পর দেখা দেয়, বিশেষত যদি প্রসব প্রক্রিয়া দীর্ঘ বা কঠিন হয়, বা অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান) এর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করা হয়। এই ব্যথা সাধারণত সাময়িক হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং মায়ের দৈনন্দিন জীবনে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রসবান্তিক ব্যথাভ্যাদাল ব্যথার কারণ:
- প্রসবকালীন আঘাত বা আঘাত:
- প্রাকৃতিক প্রসবের সময়, যেহেতু শিশুটি জন্ম নেয়, তাই পেলের পেশী, টিস্যু, লিগামেন্ট ও হাড়গুলো প্রসারিত হয়। এই প্রসারিত হওয়ার ফলে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে যদি শিশুর জন্ম কঠিন বা দীর্ঘ হয়।
- এপিসিওটোমি বা সেলাই:
- অনেক সময়, প্রসবের সময় পেরিনিয়ামের আশপাশে (যেমন, যোনির বা প্রস্টেটের চারপাশে) আঘাত হয় এবং এই আঘাতের জন্য সেলাই করতে হয়। সেলাইয়ের কারণে বা মেরামত হওয়া জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- ভ্যাগিনাল বা পেলের টিস্যুতে প্রসারিত হওয়া:
- প্রাকৃতিক প্রসবের সময় ভ্যাগিনাল (যোনির) বা পেলের টিস্যু অতিরিক্ত প্রসারিত হয়। এর ফলে সেখানে চাপ পড়ে, যা পরবর্তী সময়ে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে।
- পেলভিক জয়েন্টসের স্থিতিস্থাপকতার পরিবর্তন:
- প্রসবের সময় পেলের জয়েন্টস ও লিগামেন্টগুলি শিথিল হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। হরমোন প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন এবং রিলাক্সিনের কারণে এই পরিবর্তন ঘটে।
- সিজারিয়ান অপারেশন (C-section):
- সিজারিয়ান অপারেশনে কাটাকাটি বা মাংসপেশীতে আঘাত পায়, যার ফলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথা পরবর্তী কয়েকদিন বা সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
- শিশুর গর্ভের অবস্থান:
- শিশুর গর্ভে যদি বিশেষ কোনও অবস্থান থাকে, যেমন পিঠের দিকে বা অত্যাধিক চাপের কারণে, তবে জন্মের পর মায়ের পেলের এলাকায় ব্যথা হতে পারে।
- ফিজিক্যাল স্ট্রেস বা অতিরিক্ত কাজ:
- প্রসবের পর মায়ের শরীরে অতিরিক্ত চাপ এবং শারীরিক স্ট্রেস সৃষ্টি হতে পারে, যা ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রসবান্তিক ব্যথাভ্যাদাল ব্যথার লক্ষণ:
- পেরিনিয়াল (যৌনাঙ্গের আশপাশের) ব্যথা:
- প্রসবের পরে পেরিনিয়ামের আশপাশে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। বিশেষ করে, সেলাই বা আঘাত হওয়া জায়গায় ব্যথা হতে পারে।
- শ্রোণী (Pelvic) এলাকায় ব্যথা:
- পেলোভিক অঞ্চল বা শ्रोণী হাড়ের আশপাশে চাপ বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। ব্যথা চলার সময় বেড়ে যেতে পারে বা বসে থাকলে অনুভূত হতে পারে।
- সপ্তাহের পরও ব্যথা:
- যদি ব্যথা কয়েক সপ্তাহ পরেও না কমে, তবে এটি একটি সমস্যা হতে পারে, যেমন শারীরিক আঘাত বা যন্ত্রণা।
- শিশু জন্মের পরে প্রথম ১–২ দিন ব্যথা বাড়া:
- প্রথম এক-দুই দিন প্রসব পরবর্তী ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এর মধ্যে ইস্ট্রোগেন ও প্রোল্যাকটিনের প্রভাবের কারণে ব্যথা অনেক বাড়তে পারে।
- মূত্রত্যাগের সময় বা যৌন সম্পর্কের সময় ব্যথা:
- পেরিনিয়াল বা পেলোভিক ব্যথা কখনও কখনও মূত্রত্যাগ বা যৌন সম্পর্কের সময় বৃদ্ধি পায়, বিশেষত যদি টিস্যু বা পেশীতে সেলাই করা থাকে।
প্রসবান্তিক ব্যথাভ্যাদাল ব্যথার প্রতিকার:
- বিশ্রাম ও শিথিলতা:
- প্রসবের পর বিশ্রাম নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের শরীরকে বিশ্রাম দেয়ার মাধ্যমে পেশী এবং টিস্যু দ্রুত সুস্থ হতে পারে।
- গরম সেঁক:
- গরম পানিতে সেঁক দেওয়া পেরিনিয়াল ব্যথা উপশমে সহায়ক হতে পারে। এটি টিস্যু শিথিল করতে সাহায্য করে এবং ব্যথা কমাতে পারে।
- শীতল সেঁক (Ice Pack):
- কিছু মায়ের জন্য ঠান্ডা সেঁক বা আইস প্যাক ব্যবহার করা উপকারী হতে পারে, যা ব্যথা কমায় এবং এলাকা শীতল করে।
- এপিসিওটোমি সেলাইয়ের যত্ন নেয়া:
- যদি সেলাই করা হয়ে থাকে, তবে তা পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন। কোন ধরনের সংক্রমণ হলে তা দ্রুত চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে হবে।
- ব্যথা উপশমকারী ওষুধ (Pain Relievers):
- সাধারণত প্যারাসিটামল বা ibuprofen ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এদের ব্যবহার করা উচিত।
- পেলভিক ফিজিওথেরাপি:
- কিছু ক্ষেত্রে, পেলের পেশী শক্তিশালী করতে বিশেষ ধরনের ফিজিওথেরাপি করা যেতে পারে। এটি শারীরিক অস্বস্তি এবং ব্যথা কমাতে সহায়ক।
- শরীরের শিথিলতা ও কায়িক চাপ কমানো:
- যদি অতিরিক্ত শারীরিক কাজ বা চাপের কারণে ব্যথা হয়ে থাকে, তবে অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। কায়িক চাপ কমিয়ে রাখাও সাহায্য করবে।
- পেলভিক মুদ্রা বা স্ট্রেচিং (Pelvic Exercises):
- কিছু হালকা পেলের স্ট্রেচিং বা কেগেল এক্সারসাইজ ব্যথা উপশমে সাহায্য করতে পারে, তবে এগুলি ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- ডাক্তারের পরামর্শ:
- যদি ব্যথা ৩-৪ সপ্তাহ পরও চলে না যায় বা আরও বেড়ে যায়, তবে একজন গাইনোকোলজিস্ট বা ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত।
উপসংহার:
প্রসবান্তিক ব্যথাভ্যাদাল ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এটি সময়ের সাথে সেরে যায় এবং কিছু সাধারণ পদক্ষেপে এর উপশম ঘটানো সম্ভব। বিশ্রাম, শীতল বা গরম সেঁক, সঠিক চিকিৎসা এবং ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করলে মায়েরা সাধারণত এই সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। তবে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা গুরুতর হয়ে ওঠে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
Top of Form
Bottom of Form