গলস্টোন (Gallstone) বা পিত্তথলির পাথর হল ছোট, কঠিন টুকরো যা পিত্তথলিতে (gallbladder) গঠিত হয়। পিত্তথলি হল একটি ছোট অঙ্গ যা যকৃৎ (liver) থেকে পিত্ত (bile) সংগ্রহ করে, যা খাবার হজম করতে সহায়তা করে। পিত্তথলির মধ্যে পাথর গঠন হলে এটি গলস্টোন বা পিত্তথলির পাথুরীপীড়া সৃষ্টি করতে পারে। এটি একটি সাধারণ সমস্যা, তবে অনেক সময় এটি কোনো উপসর্গ তৈরি না করেও থাকতে পারে। তবে পাথর বড় হলে বা পিত্তথলির কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে।
গলস্টোনপাথুরীপীড়া (Gallstone Disease) বা পিত্তথলির পাথরের কারণ:
গলস্টোন সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- কলেস্টেরল গলস্টোন (Cholesterol Gallstones):
- এই ধরনের পাথর প্রধানত পিত্তে থাকা অতিরিক্ত কলেস্টেরলের কারণে গঠিত হয়।
- পিগমেন্ট গলস্টোন (Pigment Gallstones):
- এই পাথর গঠিত হয় বিলিরুবিনের অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে। বিলিরুবিন হল রক্তের এক ধরনের পদার্থ যা যকৃৎ দ্বারা তৈরি হয়।
গলস্টোন বা পিত্তথলির পাথর হওয়ার কিছু কারণ:
- অতিরিক্ত কলেস্টেরল:
- পিত্তের অতিরিক্ত কলেস্টেরল গলস্টোন তৈরি করতে সহায়তা করে।
- পিত্তের অভাব:
- পিত্তথলির যথাযথ কার্যক্রম না হলে, পিত্তের অভাব সৃষ্টি হতে পারে, যা গলস্টোন গঠনের কারণ হতে পারে।
- বয়স:
- ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে গলস্টোন হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
- লিঙ্গ:
- মহিলাদের মধ্যে গলস্টোনের সমস্যা পুরুষদের তুলনায় বেশি দেখা যায়, বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে।
- বংশগত বা পারিবারিক ইতিহাস:
- যদি পরিবারে গলস্টোন বা পিত্তথলির কোনো সমস্যা থাকে, তবে সেই ব্যক্তির গলস্টোন হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
- অতিরিক্ত ওজন বা মোটা হওয়া (Obesity):
- অতিরিক্ত মেদ বা মোটা হওয়া গলস্টোনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ এটি পিত্তের মধ্যে অতিরিক্ত কলেস্টেরল জমা হতে সহায়তা করে।
- প্রেগন্যান্সি:
- গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন গলস্টোনের সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভধারণের কারণে পিত্তথলির কার্যক্রমে পরিবর্তন হতে পারে।
- ডায়াবেটিস বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা:
- ডায়াবেটিস, লিভারের সমস্যা বা উচ্চ রক্তচাপও গলস্টোনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
- চর্বি, মিষ্টি ও অত্যন্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি আসক্তি গলস্টোনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
গলস্টোনপাথুরীপীড়ার লক্ষণ:
গলস্টোনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ থাকে না এবং এটি “সাইলেন্ট স্টোন“ হিসেবে পরিচিত। তবে যখন পাথর গলাতে বাধা সৃষ্টি করে বা পিত্তনালীতে আটকে যায়, তখন কিছু লক্ষণ দেখা দেয়:
- অধিক ব্যথা বা “বিলিয়ারি কলিক” (Biliary Colic):
- গলার ডান পাশের বা পেটের উপরের ডান দিকে তীব্র ব্যথা অনুভূতি, যা সাধারণত খাবার খাওয়ার পরে খারাপ হতে পারে।
- বমি বা বমির অনুভূতি:
- পিত্তথলির পাথর আটকে গেলে বমি হতে পারে।
- গ্যাস, অস্বস্তি বা পেট ফোলা:
- পেটের উপরের অংশে অস্বস্তি বা গ্যাস হওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
- হালকা জ্বর:
- পিত্তথলির প্রদাহ বা সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে।
- চর্মের হলুদ হওয়া (যকৃতের সমস্যা):
- পিত্তনালীতে পাথর আটকে গেলে যকৃত থেকে পিত্ত ঠিকভাবে বের হতে পারে না, যার ফলে চর্মের হলুদ হওয়া বা জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
- দীর্ঘ সময়ের জন্য খাবার গিলতে সমস্যা:
- গলস্টোনের কারণে খাবার গিলতে বা হজম করতে অসুবিধা হতে পারে।
গলস্টোনপাথুরীপীড়ার প্রতিকার:
- ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা:
- গলস্টোনের সমস্যা কমানোর জন্য উত্তেজক ওষুধ বা পিটাইটাইটিকস দেওয়া হতে পারে। তবে এসব ওষুধের মাধ্যমে পাথর পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে ছোট পাথর নরম হয়ে যায়।
- অস্ত্রোপচার (Cholecystectomy):
- গলস্টোন অপসারণের জন্য পিত্তথলি অপসারণ (Cholecystectomy) সার্জারি সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা। এটি সাধারণত ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বা “কীhole” সার্জারির মাধ্যমে করা হয়, যাতে দ্রুত সুস্থতা পাওয়া যায়।
- পিট্টের পাথর ভাঙার জন্য কিছু চিকিৎসা:
- কিছু ক্ষেত্রে পাথর ভাঙতে এন্ডোস্কোপিক রিট্রোগ্রেড কলাঙ্গিওপ্যানক্রিয়োগ্রাফি (ERCP) পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন:
- সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খাওয়া গলস্টোনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
- পানি বেশি পান করা:
- পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা গলস্টোনের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করতে পারে।
গলস্টোন একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, যদি সমস্যা গুরুতর হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।