গলনালী প্রদাহ (Laryngitis) হলো গলনালী (larynx) বা ভোকাল কর্ডের (vocal cords) প্রদাহ, যা সাধারণত গলা ব্যথা, গলার ভিতরে অস্বস্তি এবং গলা দিয়ে কথা বলার সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে ঘটে, তবে অন্য কারণেও এটি হতে পারে। গলনালী প্রদাহে গলার স্বর বদলে যেতে পারে এবং কথা বলা বা গিলতে সমস্যা হতে পারে।
গলনালী প্রদাহের কারণ:
- ভাইরাল সংক্রমণ (Viral Infection):
- গলনালী প্রদাহের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ভাইরাল সংক্রমণ, যা সাধারণ সর্দি, ফ্লু, বা অন্যান্য ভাইরাসের কারণে হতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ (Bacterial Infection):
- কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণও গলনালী প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন স্ট্রেপটোকোক্কাস ব্যাকটেরিয়া।
- অতিরিক্ত কথা বলা বা চিৎকার করা (Overuse of the Voice):
- দীর্ঘ সময় ধরে বা উচ্চস্বরে কথা বলা, চিৎকার করা বা গান গাওয়ার কারণে ভোকাল কর্ডে চাপ পড়ে এবং প্রদাহ হতে পারে।
- ধূমপান (Smoking):
- ধূমপান গলার মিউকাস মেমব্রেনকে শুষ্ক করে ফেলে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- দূষিত বায়ু (Air Pollution):
- দূষিত বাতাস, গ্যাস বা ধূমপান গলার শ্লেষ্মা ও টিস্যুতে ক্ষতি করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যালার্জি (Allergies):
- পলল, গাছের রেণু, ধূলিকণা ইত্যাদির কারণে অ্যালার্জি গলা ও শ্বাসনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাগিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD):
- পেটের এসিড খাদ্যনালী থেকে উঠে গলায় প্রবাহিত হলে এটি গলার শ্লেষ্মা বা মিউকাস মেমব্রেনে ক্ষতি করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
গলনালী প্রদাহের লক্ষণ:
- গলা ব্যথা (Sore Throat):
- গলার মধ্যে ব্যথা, শুষ্কতা বা জ্বালাপোড়া অনুভূতি হতে পারে।
- স্বরের পরিবর্তন (Hoarseness):
- গলার ভিতরে প্রদাহের কারণে স্বর বদলে যেতে পারে এবং গলার স্বর কাঁপানো বা অস্বাভাবিক হতে পারে।
- কথা বলার সমস্যা (Difficulty Speaking):
- কথা বলার সময় অস্বস্তি বা কষ্ট হতে পারে এবং দীর্ঘ সময় কথা বলা কঠিন হতে পারে।
- গলা থেকে কাশি (Cough):
- গলনালী প্রদাহের কারণে শুষ্ক কাশি বা কাশি আসতে পারে, বিশেষ করে রাতে।
- গলার মধ্যে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি (Lump in the Throat):
- অনেক সময় গলার মধ্যে কিছু আটকে থাকার বা চাপ অনুভূতি হতে পারে।
- গলা শুকনো বা শুষ্ক অনুভূতি (Dry Throat):
- গলায় শুষ্কতা এবং চুলকানির অনুভূতি হতে পারে, যা আরও ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- শ্বাস নেয়ার সমস্যা (Difficulty Breathing):
- যদি প্রদাহ গুরুতর হয়, তবে শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে, যা শ্বাসনালীর সংকোচন সৃষ্টি করে।
গলনালী প্রদাহের প্রতিকার:
- ভোকাল রেস্ট (Voice Rest):
- অতিরিক্ত কথা বলা বা চিৎকার করা থেকে বিরত থাকুন। গলার পেশি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কথা না বলার চেষ্টা করুন।
- গরম পানির গার্গল (Warm Saltwater Gargle):
- গরম লবণ পানিতে গার্গল করতে পারেন, যা গলার প্রদাহ কমাতে সাহায্য করবে।
- হালকা গরম পানীয় (Warm Fluids):
- গরম চা বা মধু-লেবু মিশিয়ে পান করতে পারেন, যা গলা শিথিল করে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- গরম ভাপ (Steam Inhalation):
- গরম পানির ভাপ শ্বাসনালীতে প্রবাহিত করতে পারেন। এটি গলার শুষ্কতা কমাবে এবং গলার টিস্যুকে শিথিল করবে।
- মধু ও আদা (Honey and Ginger):
- মধু ও আদা গলা শিথিল করতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি গরম পানিতে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে।
- অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (Anti-inflammatory medications):
- প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ধরনের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ধূমপান পরিহার করুন (Avoid Smoking):
- গলার প্রদাহ বা অন্যান্য শ্বাসজনিত সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে ধূমপান, তাই এটি পরিহার করা উচিত।
- এলার্জি ওষুধ (Antihistamines):
- যদি অ্যালার্জির কারণে গলনালী প্রদাহ হয়, তবে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ নিতে পারেন।
- এনজাইম বা পিপেরমিন্ট লজেঞ্জ (Lozenges):
- গলা শিথিল করতে এবং ব্যথা কমাতে আপনি লজেঞ্জ বা গলা স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন।
- ভাইরাল সংক্রমণের জন্য বিশ্রাম:
- ভাইরাল সংক্রমণজনিত গলনালী প্রদাহ হলে বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত এটি স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়।
- ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক:
- যদি গলনালী প্রদাহ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হতে পারে।
সতর্কতা:
- যদি গলনালী প্রদাহ দীর্ঘস্থায়ী হয় (৭ দিন বা তার বেশি), অথবা যদি গুরুতর লক্ষণ যেমন শ্বাসকষ্ট, উচ্চ জ্বর, গলার ভিতরে ফোলা, বা রক্তপাত দেখা দেয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
- শ্বাসকষ্ট বা ভোকাল কর্ড প্যারালাইসিস (ভোকাল কর্ডের অসাড়তা) হতে পারে যদি গলনালী প্রদাহ গুরুতর হয়, তাই দেরি না করে চিকিৎসা করা উচিত।
গলনালী প্রদাহ সাধারণত ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, এবং উপযুক্ত চিকিৎসা ও বিশ্রামের মাধ্যমে এটি সহজেই সেরে যায়। তবে যদি লক্ষণ গুরুতর হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।