এডিনয়েড (Adenoids) হলো গলার পিছনে, নাকের নিচে এবং মুখগহ্বরের উপরের দিকে একটি ছোট লিম্ফ্যাটিক টিস্যু গ্রন্থি, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম এর অংশ হিসেবে কাজ করে। এটি শিশুদের মধ্যে বিশেষত উল্লেখযোগ্য এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সাধারণত ছোট হয়ে যায় অথবা অন্তর্হিত হয়ে যায়।
এডিনয়েডের কারণ:
এডিনয়েড সাধারণত একটি টিস্যু যা শরীরের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। তবে, কখনো কখনো এটি অতিরিক্ত প্রদাহিত হয়ে এডিনয়ড হাইপারট্রফি (Adenoid Hypertrophy) বা এডিনয়েডের আকার বাড়ানো হয়ে যায়, যা বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে:
- ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ (Viral or Bacterial Infection):
- গলা বা নাকে সংক্রমণ, যেমন সর্দি, ফ্লু বা স্ট্রেপটোকোক্কাল ইনফেকশন (Streptococcal Infection), এডিনয়েডের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যালার্জি (Allergy):
- ধূলা, পলল, পশুর পশম বা পরিবেশগত অ্যালার্জেনও এডিনয়েডের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাগিয়াল রিফ্লাক্স (GERD):
- এসিড রিফ্লাক্স রোগে, গ্যাস্ট্রিক এসিড খাদ্যনালী থেকে উপরে উঠে গলার পিছনে পৌঁছাতে পারে, যা এডিনয়েডের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- শ্বাসতন্ত্রের রোগ (Respiratory Infections):
- সর্দি, কাশি বা অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণও এডিনয়েডকে আক্রান্ত করতে পারে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ বা প্রদাহ (Chronic Infection or Inflammation):
- যদি এডিনয়েড দীর্ঘ সময় ধরে প্রদাহিত থাকে, তবে এটি স্থায়ী আকারে বড় হতে পারে।
এডিনয়েডের লক্ষণ:
এডিনয়েডের আকার বড় হলে, এটি নাক দিয়ে শ্বাস নিতে বা গলা থেকে শ্বাস নিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছু লক্ষণ তৈরি হয়:
- নাক বন্ধ হওয়া (Nasal Congestion):
- নাক দিয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে, বিশেষত রাতে। এটি শিশুদের মধ্যে খুব সাধারণ।
- নাক দিয়ে শব্দ হওয়া (Mouth Breathing):
- এডিনয়েডের কারণে নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া কঠিন হলে, ব্যক্তিরা মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করতে পারেন।
- শ্বাসকষ্ট (Difficulty Breathing):
- শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে যখন এডিনয়েড বড় হয়ে যায় এবং গলার বা নাকের পথ সংকুচিত হয়।
- ঘুমের সমস্যা (Sleep Disturbances):
- এডিনয়েডের আকার বড় হলে, ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) সৃষ্টি করতে পারে। এতে মুখ দিয়ে ঘুমানোর সময় নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- শব্দপূর্ণ বা গ্রাঁগ্রান্ট কাশি (Persistent Cough):
- শ্বাসনালীর উপর চাপ পড়লে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হতে পারে।
- গলার প্রদাহ (Sore Throat):
- এডিনয়েডের কারণে গলার ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে, কারণ এটি গলার শ্লেষ্মা বা টিস্যুর উপরে চাপ সৃষ্টি করে।
- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি (Fever):
- যদি এডিনয়েডে সংক্রমণ থাকে, তবে এটি জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে পারে।
- শরীরের মধ্যে ব্যথা (Facial Pain or Pressure):
- এডিনয়েডের প্রদাহ হলে এটি মুখমন্ডল বা গাল ফোলানোর মতো লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।
- কণ্ঠের পরিবর্তন (Change in Voice):
- গলার বা নাকের শ্বাসনালীতে অবরোধ থাকার কারণে কণ্ঠ ভারী বা বিকৃত হয়ে যেতে পারে।
এডিনয়েডের প্রতিকার:
এডিনয়েডের আকার বড় হলে এবং এতে সমস্যার সৃষ্টি করলে, চিকিৎসা প্রক্রিয়া প্রয়োজন হতে পারে। সাধারণত এটি চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়:
- ওষুধ (Medications):
- এন্টিহিস্টামিন (Antihistamines) এবং স্টেরয়েড স্প্রে (Steroid Sprays) ব্যবহার করা যেতে পারে, যা এডিনয়েডের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকলে, অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics) দেওয়া হতে পারে।
- গরম পানি দিয়ে গার্গল (Saltwater Gargles):
- গলা শিথিল করতে এবং প্রদাহ কমাতে গরম লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা যেতে পারে।
- শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম (Breathing Exercises):
- শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা গলার চাপ কমাতে সহায়তা করে এবং শ্বাস নেওয়া সহজ করে।
- অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণ (Managing Allergies):
- অ্যালার্জির কারণে যদি এডিনয়েডে প্রদাহ হয়, তবে অ্যালার্জি নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন বা স্টেরয়েড ট্যাবলেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
- গরম স্যুপ বা পানীয় (Warm Liquids):
- গলা এবং নাকের শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে গরম স্যুপ বা পানীয় খাওয়া সহায়ক হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট নিরাময়ের জন্য ** (Nasal Decongestants):
- শ্বাসকষ্ট কমাতে নাসাল ডিকনজেসট্যান্ট (Nasal Decongestants) ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এটি শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা উচিত।
- এডিনয়েড অপসারণ (Adenoidectomy):
- যদি এডিনয়েড খুব বড় হয়ে যায় এবং নিয়মিত সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে এডিনয়েড অপসারণ (Adenoidectomy) একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকরী চিকিৎসা হতে পারে। এটি সাধারণত সার্জারি মাধ্যমে করা হয়, এবং সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি হয়ে থাকে।
- অপারেশন (Surgery):
- যদি এডিনয়েডের প্রদাহ খুব গুরুতর হয়ে যায় এবং ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসা কার্যকর না হয়, তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এডিনয়েড অপসারণ করা হতে পারে। এটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে করা হয় যারা বারবার সংক্রমণের শিকার হন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- যদি শিশু বা ব্যক্তি গলা বা নাক বন্ধ হওয়ার কারণে শ্বাস নিতে সমস্যা অনুভব করে।
- যদি এডিনয়েডের কারণে ঘুমের সমস্যা, যেমন স্লিপ অ্যাপনিয়া, সৃষ্টি হয়।
- যদি দীর্ঘ সময় ধরে জ্বর, কাশি বা গলা ব্যথা থাকে।
- যদি গলার বা মুখের ভিতরে চাপে ব্যথা অনুভূত হয়।
- যদি এডিনয়েড আকারে বৃদ্ধি পেয়ে নিয়মিত সর্দি বা শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে।
এডিনয়েড সাধারণত শিশুকালেই দেখা যায় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছোট হয়ে যায় বা সরেও যেতে পারে, তবে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।