ফোলা হাঁটু (Swollen Knee) হলো হাঁটুর চারপাশে অতিরিক্ত তরল জমে যাওয়ার কারণে হাঁটু ফুলে যাওয়া। এটি হাঁটুর যে কোনো অংশে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহের কারণে হতে পারে এবং হাঁটুর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। হাঁটুর ফোলাভাব সাধারণত আঘাত, প্রদাহ, বা অন্য শারীরিক সমস্যা যেমন সংক্রমণ বা গেঁটে বাতের কারণে হতে পারে। হাঁটু শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্ট, তাই এর ফোলাভাব অনেক সময় চলাফেরায় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কারণ:
ফোলা হাঁটু হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- আঘাত বা ইনজুরি (Injury):
- হাঁটুতে আঘাত লাগলে যেমন মচকানো, ফেটে যাওয়া, লিগামেন্ট বা টিস্যুর ক্ষতি, সেগুলোর কারণে হাঁটুতে ফোলাভাব সৃষ্টি হতে পারে।
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis):
- হাঁটুর জয়েন্টে অস্টিওআর্থ্রাইটিস থাকলে জয়েন্টের হাড় ও কারটিলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা হাঁটুতে ব্যথা ও ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে।
- গেঁটে বাত (Gout):
- গেঁটে বাত একটি রিউম্যাটিক রোগ, যেখানে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের অতিরিক্ত সঞ্চয় হতে পারে এবং এটি হাঁটুর জয়েন্টে তীব্র ব্যথা এবং ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে।
- রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis):
- রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলো একটি অটোইমিউন রোগ যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম জয়েন্টগুলো আক্রমণ করে, হাঁটুর জয়েন্টেও প্রদাহ ও ফোলাভাব সৃষ্টি হতে পারে।
- বুরুসাইটিস (Bursitis):
- হাঁটুর আশেপাশে বুরুস নামে একটি তরল ভর্তি থলির প্রদাহ হলে হাঁটুর ফোলাভাব হতে পারে। এটি সাধারণত হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ পড়লে বা আঘাতের কারণে হয়ে থাকে।
- টেনডোনাইটিস (Tendinitis):
- হাঁটুর টেনডন (কোষ) প্রদাহিত হলে, যেমন হাঁটুর পেটেলা টেনডন বা এক্সটেনসরের টেনডন প্রদাহ, হাঁটুর ফোলাভাব হতে পারে।
- আন্ত্রিক ইনফেকশন (Infection):
- হাঁটুর জয়েন্টে যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটে, যেমন সেপটিক আর্থ্রাইটিস, তাতে হালকা থেকে মারাত্মক ফোলাভাব, ব্যথা এবং জ্বর দেখা দিতে পারে।
- ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস (Deep Vein Thrombosis – DVT):
- পায়ের শিরায় রক্ত জমে গেলে, সেই রক্তপাত হাঁটুর আশপাশে ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে।
- লিগামেন্ট বা কারটিলেজের ক্ষতি (Ligament or Cartilage Damage):
- হাঁটুতে লিগামেন্ট বা কারটিলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাঁটুর ফোলাভাব ও ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে হাঁটুর মুভমেন্টে সমস্যা হতে পারে।
- অতিরিক্ত শারীরিক চাপ (Overuse):
- দীর্ঘ সময় হাঁটাহাঁটি বা অতিরিক্ত শরীরচর্চা (বিশেষত খুব বেশি চাপ দেওয়া) হাঁটুর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং হাঁটু ফুলে যেতে পারে।
লক্ষণ:
ফোলা হাঁটুতে কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- ফোলাভাব (Swelling):
- হাঁটুর চারপাশে বা পুরো হাঁটুতে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত হাঁটুর বিভিন্ন অংশে তরল জমা হওয়ার কারণে হয়।
- ব্যথা (Pain):
- হাঁটুর ফোলাভাবের সাথে ব্যথা হতে পারে। এটি সাধারণত হাঁটু মুভমেন্টে বা চাপ দিলে বাড়তে পারে।
- গরম বা তাপ (Heat):
- হাঁটুর প্রদাহের কারণে ফোলা অংশে গরম বা তাপ অনুভূতি হতে পারে।
- লালচে বা গা dark ় ত্বক (Redness or Discoloration):
- হাঁটুর ত্বকে লালচে বা গা dark ় রঙের পরিবর্তন হতে পারে, যা প্রদাহের লক্ষণ।
- চলাফেরায় অসুবিধা (Difficulty Walking):
- হাঁটুর ফোলাভাব ও ব্যথার কারণে চলাফেরা করতে সমস্যা হতে পারে এবং হাঁটুতে শক্তি বা নমনীয়তা কমে যেতে পারে।
- সকালে শক্তি অনুভূতি (Morning Stiffness):
- সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটু শক্ত বা জমে থাকা অনুভূতি হতে পারে, যা কিছুক্ষণ পর আরামদায়ক হয়।
- তাড়াতাড়ি ক্লান্তি (Fatigue):
- হাঁটুর ফোলাভাবের কারণে শরীরের অস্বস্তি হতে পারে এবং দ্রুত ক্লান্তি অনুভব হতে পারে।
প্রতিকার:
ফোলা হাঁটুর চিকিৎসা তার কারণের ওপর নির্ভর করে। তবে কিছু সাধারণ প্রতিকার দেওয়া হলো:
- বিশ্রাম (Rest):
- হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেওয়ার জন্য বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। হাঁটুর আরাম দেয়ার জন্য অতিরিক্ত চলাফেরা বা দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে।
- বরফ সেঁক (Ice Pack):
- হাঁটুর ফোলা অংশে বরফ সেঁক দেওয়ার ফলে ব্যথা এবং প্রদাহ কমানো যেতে পারে। ১৫-২০ মিনিটের জন্য বরফ সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
- গোড়ালি উত্তোলন (Elevation):
- হাঁটু বা পা উপরের দিকে তুলে রাখলে (বিশেষত শোবার সময়) তরল জমা কমে এবং ফোলাভাব কমতে সাহায্য করে।
- কমপ্রেশন (Compression):
- হাঁটুতে কমপ্রেশন ব্যান্ডেজ বা সাকার ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে এবং হাঁটুর মুভমেন্টে সহায়তা দেয়।
- ওষুধ (Medications):
- প্রদাহ কমাতে NSAIDs (Nonsteroidal Anti-Inflammatory Drugs) যেমন আইবুপ্রোফেন বা নাপ্রোক্সেন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এসব ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।
- ফিজিওথেরাপি (Physiotherapy):
- হাঁটুর মুভমেন্ট এবং শক্তি বাড়াতে ফিজিওথেরাপি সহায়ক হতে পারে। এতে বিশেষ ব্যায়াম করা হয় যাতে হাঁটুর নমনীয়তা এবং শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- পানি পান করা (Hydration):
- পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- অপারেশন (Surgery):
- যদি হাঁটুর আঘাত বা প্রদাহ গুরুতর হয় এবং অন্যান্য চিকিৎসা কার্যকর না হয়, তবে হাঁটুর অপারেশন বা জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে।
- রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটে বাতের চিকিৎসা:
- যদি ফোলাভাব রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটে বাতের কারণে হয়, তবে এই রোগের চিকিৎসা এবং নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
শেষ কথা:
ফোলা হাঁটু সাধারণত একেবারে গুরুতর সমস্যা নয়, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদী হলে বা যন্ত্রণাদায়ক হলে, ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে হাঁটুর ফোলাভাব কমানো সম্ভব এবং হাঁটুর কার্যক্ষমতা বজায় রাখা যায়।