হাঁটুর ইনজুরি (Knee Injury) হলো হাঁটুর যে কোনও অংশে আঘাত বা ক্ষতি হওয়া, যা হাঁটুর কার্যক্ষমতা এবং চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। হাঁটু শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল জয়েন্টগুলির মধ্যে একটি, যা হাঁটা, দৌড়ানো, বসা বা দাঁড়ানোর সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাঁটুর ইনজুরি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন খেলার মাঠে আঘাত, দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত চাপ, বা বয়সজনিত কারণে।
কারণ:
হাঁটুর ইনজুরির বিভিন্ন কারণ হতে পারে:
- হাড় ভেঙে যাওয়া (Fracture): হাঁটুর হাড় ভাঙলে এটি একটি গুরুতর ইনজুরি হতে পারে, যা প্রচণ্ড ব্যথা সৃষ্টি করে এবং হাঁটার ক্ষমতা হারাতে পারে।
- লিগামেন্ট ইনজুরি (Ligament Injury): হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরি একটি সাধারণ ইনজুরি। সবচেয়ে সাধারণ লিগামেন্ট ইনজুরির মধ্যে এসি এল (ACL) ইনজুরি (Anterior Cruciate Ligament) এবং পিএলএল (PCL) ইনজুরি অন্তর্ভুক্ত। এই ধরনের ইনজুরি সাধারণত খেলা, দৌড়ানো, বা আকস্মিক গতির পরিবর্তনজনিত হয়।
- মেনিস্কাস টিয়ার (Meniscus Tear): হাঁটুর মেনিস্কাস হলো একটি কারটিলেজ যা হাঁটুর ফেমার এবং টিবিয়ার হাড়ের মধ্যে অবস্থিত। এটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে হাঁটুর কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- টেনডন ইনজুরি (Tendon Injury): হাঁটুর টেন্ডন বা পেশীতে ইনজুরি হলে (যেমন প্যাটেলার টেনডন ইনজুরি), হাঁটুর স্থিতিস্থাপকতা ও শক্তি কমে যায়, এবং চলাচলে অসুবিধা হতে পারে।
- বুরসাইটিস (Bursitis): হাঁটুর আশেপাশে ছোট ছোট তরলভর্তি থলিগুলির প্রদাহ হলে বুরসাইটিস হতে পারে। এই কারণে হাঁটুর আশেপাশে ব্যথা এবং স্ফীতি হতে পারে।
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis): বয়সজনিত কারণে হাঁটুর জয়েন্টের কারটিলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে, যা হাঁটুর ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- অতিরিক্ত চাপ বা অতিরিক্ত চলাফেরা: অতিরিক্ত দৌড়ানো, হাঁটা, বা দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটুর উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়লে এটি ইনজুরি সৃষ্টি করতে পারে।
লক্ষণ:
হাঁটুর ইনজুরির কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- ব্যথা (Pain): হাঁটুর ইনজুরির সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো ব্যথা। ব্যথা সাধারণত হাঁটুর জয়েন্টে বা এর আশেপাশে অনুভূত হয়।
- ফুলে যাওয়া (Swelling): হাঁটুর ইনজুরির কারণে হাঁটু ফুলে যেতে পারে। এটি আঘাতের পর সাধারণত ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখা দেয়।
- লাল হয়ে যাওয়া (Redness): হাঁটুর আশেপাশে লালচে বা গরম অনুভূতি হতে পারে, বিশেষত যদি ইনফেকশন বা প্রদাহ থাকে।
- চলাফেরায় সমস্যা (Difficulty Walking): হাঁটুর ইনজুরি হলে হাঁটতে বা চলাফেরা করতে অসুবিধা হতে পারে। কিছু ইনজুরিতে হাঁটুর জড়তা বা শক্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
- ক্র্যাকিং বা পপিং শব্দ (Cracking or Popping Sound): কিছু ইনজুরিতে হাঁটুর মধ্যে ক্র্যাকিং বা পপিং শব্দ শোনা যেতে পারে, যেমন মেনিস্কাস টিয়ার বা লিগামেন্ট ইনজুরির ক্ষেত্রে।
- অবশত্ব বা শিরশির (Numbness or Tingling): হাঁটুর ইনজুরির কারণে পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলে অবশত্ব বা শিরশির অনুভূতি হতে পারে।
- হাঁটু লক হয়ে যাওয়ার অনুভূতি (Knee Locking): কিছু ক্ষেত্রে হাঁটু আটকে যেতে পারে, যেমন মেনিস্কাস টিয়ার বা লিগামেন্ট ইনজুরির কারণে হাঁটুর স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিকার:
হাঁটুর ইনজুরি নির্ভর করে ইনজুরির ধরণ ও গুরুত্বের উপর। কিছু সাধারণ প্রতিকার হলো:
- বিশ্রাম (Rest): ইনজুরির পর হাঁটু বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত চলাফেরা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- আইস সেঁক (Ice Compression): হাঁটুর ওপর বরফ দিয়ে সেঁক দেওয়া হলে ব্যথা ও ফুলে যাওয়া কমে। এটি সাধারণত ১৫-২০ মিনিট করে, দিনে ৩-৪ বার করা উচিত।
- গরম সেঁক (Heat Compression): কিছু ক্ষেত্রে গরম সেঁকও ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষত পেশী টান বা প্রদাহের ক্ষেত্রে।
- পেইন কিলার ওষুধ (Pain Relievers): প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের মতো পেইন কিলার ওষুধ ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ফিজিওথেরাপি (Physiotherapy): হাঁটুর ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হাঁটুর শক্তি এবং নমনীয়তা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে।
- টেনডন বা লিগামেন্ট সাপোর্ট (Knee Braces): হাঁটুর ইনজুরিতে হাঁটুর সাপোর্ট বা ব্রেস ব্যবহার করলে হাঁটুর ওপর চাপ কমানো যেতে পারে এবং হাঁটুর সুরক্ষা বৃদ্ধি পায়।
- স্টেরয়েড ইনজেকশন (Steroid Injections): কিছু ইনজুরি বা প্রদাহের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে, যা প্রদাহ কমায় এবং ব্যথা হ্রাস করে।
- অস্ত্রোপচার (Surgery): যদি ইনজুরি গুরুতর হয় বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়, তবে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মেনিস্কাস টিয়ার বা লিগামেন্ট পুনর্গঠন করার জন্য সার্জারি করা হতে পারে।
- রিহ্যাবিলিটেশন (Rehabilitation): হাঁটুর ইনজুরির পর পূর্ণ সেরে ওঠার জন্য রিহ্যাবিলিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে চলাচল ও শক্তি পুনরুদ্ধার করা যায়।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ (Weight Control): হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ কমানোর জন্য স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা উচিত। এটি হাঁটুর ইনজুরি প্রতিরোধে সহায়ক।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:
হাঁটুর ইনজুরি গুরুতর হলে বা উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন:
- যদি হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয় বা চলাফেরা অসম্ভব হয়ে যায়।
- যদি হাঁটু ফুলে যায় এবং এটি অনেক দিন স্থায়ী হয়।
- যদি হাঁটুর মধ্যে পপিং বা ক্র্যাকিং শব্দ শোনা যায় এবং হাঁটু লক হয়ে যায়।
- যদি হাঁটুর ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার পরেও ব্যথা বা অসুবিধা থাকে।
এছাড়া, যদি হাঁটুর ইনজুরি গুরুতর হয় বা কোনো ধরনের আঘাতের পর হাঁটুর অস্থিরতা বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, তবে তাত্ক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।