স্নায়ুপ্রদাহ (Neuritis) হলো স্নায়ু সিস্টেমে প্রদাহ বা স্নায়ুর শিরা বা স্নায়ুর কোষের প্রদাহের কারণে সৃষ্ট একটি শারীরিক অবস্থা। এটি স্নায়ু ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশে হতে পারে এবং সাধারণত স্নায়ুর কার্যকারিতা ব্যাহত করে। স্নায়ুপ্রদাহের কারণে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে ব্যথা, শিরা বা পেশীজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
কারণ:
স্নায়ুপ্রদাহের কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে স্নায়ুপ্রদাহ হতে পারে। যেমন, হারপিস ভাইরাস (Herpes Zoster) বা হেপাটাইটিস B এবং C ভাইরাসের কারণে স্নায়ুপ্রদাহ হতে পারে।
- ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের অভাব, স্নায়ুর ক্ষতি বা প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হতে পারে।
- অটোইমিউন ডিজিজ: অটোইমিউন ডিজিজ যেমন গিল্যান-ব্যারে সিনড্রোম (Guillain-Barré Syndrome) স্নায়ুপ্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই স্নায়ুকে আক্রমণ করে।
- ভিটামিনের অভাব: ভিটামিন B12, B1, বা ফোলিক অ্যাসিডের অভাব স্নায়ুক্ষতির কারণ হতে পারে, যা স্নায়ুপ্রদাহের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- মদ্যপান বা মাদক সেবন: দীর্ঘকাল মদ্যপান বা মাদক সেবনের ফলে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে এবং প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। এটি আলকোহলিক নিউরোপ্যাথি নামে পরিচিত।
- গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় শরীরের স্নায়ু সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটে, যা কিছু ক্ষেত্রে স্নায়ুপ্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- শরীরিক আঘাত: দুর্ঘটনা বা শারীরিক আঘাতের ফলে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়লে, প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, পিঠের আঘাতের ফলে স্নায়ুপ্রদাহ হতে পারে।
- টিউমার: স্নায়ুর ওপর কোনো টিউমারের চাপ থাকলে স্নায়ুপ্রদাহ হতে পারে।
- ধূমপান: দীর্ঘকাল ধূমপান স্নায়ুতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং স্নায়ুপ্রদাহের সম্ভাবনা বাড়ায়।
লক্ষণ:
স্নায়ুপ্রদাহের লক্ষণগুলি আক্রান্ত স্নায়ুর অবস্থান এবং প্রকারের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- ব্যথা: স্নায়ুপ্রদাহের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো ব্যথা। এটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অংশে অনুভূত হয়, যেমন হাতে, পায়ে বা পিঠে।
- অস্বস্তি বা ঝিঁঝিঁ অনুভূতি: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে আক্রান্ত স্থানে অস্বস্তি, ঝিঁঝিঁ বা পিপঁড়ের কামড়ের মতো অনুভূতি হতে পারে।
- পেশী দুর্বলতা: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং আক্রান্ত অঞ্চলে চলাফেরা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
- শারীরিক অক্ষমতা: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে, বিশেষ করে পেশী সংক্রান্ত স্নায়ুর ক্ষেত্রে, শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে, যেমন হাঁটতে বা কিছু তোলা কঠিন হতে পারে।
- তাপমাত্রা অনুভূতি কমে যাওয়া: কখনও কখনও স্নায়ুপ্রদাহের কারণে তাপমাত্রা অনুভূতি কমে যেতে পারে, বিশেষ করে হাতে বা পায়ে।
- অল্প চাপেই ব্যথা বা অস্বস্তি বৃদ্ধি: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে অল্প চাপের মধ্যে ব্যথা বা অস্বস্তি বৃদ্ধি হতে পারে।
- চালনা বা শ্বাসকষ্ট: কিছু ক্ষেত্রে, স্নায়ুপ্রদাহের কারণে শরীরের কোনো বিশেষ অংশে চলাচল করা বা শ্বাস নেওয়ার সমস্যা হতে পারে।
- তীব্র মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন: স্নায়ুপ্রদাহ কখনও কখনও মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের কারণও হতে পারে।
প্রতিকার:
স্নায়ুপ্রদাহের প্রতিকার মূলত এর কারণ নির্ভর করে এবং এটি চিকিত্সকের পরামর্শ অনুসারে হওয়া উচিত। কিছু সাধারণ প্রতিকার হলো:
- ঔষধের ব্যবহার:
- পেইন কিলার (Painkiller): স্নায়ুপ্রদাহের জন্য সাধারণত ব্যথা কমানোর ঔষধ যেমন প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। তবে, দীর্ঘ সময়ের জন্য ঔষধ ব্যবহার না করাই ভালো।
- অ্যান্টি–ইনফ্লেমেটরি ওষুধ: স্নায়ুপ্রদাহ কমানোর জন্য অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বা প্রদাহবিরোধী ওষুধ যেমন স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে (ডাক্তারের পরামর্শে)।
- ভিটামিন B12 ও B1: যদি স্নায়ুপ্রদাহ ভিটামিনের অভাবের কারণে হয়, তবে ভিটামিন B12, B1 বা ফোলিক অ্যাসিডের সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ফিজিওথেরাপি: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে শারীরিক অক্ষমতা বা পেশী দুর্বলতা থাকলে, ফিজিওথেরাপি কার্যকর হতে পারে। এটি পেশী শক্তিশালী করতে এবং চলাচলের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।
- শারীরিক বিশ্রাম: শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া উচিত, কারণ স্নায়ুপ্রদাহের সময়ে অতিরিক্ত শারীরিক কার্যকলাপ করলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
- হট অ্যান্ড কোল্ড প্যাক ব্যবহার: স্নায়ুপ্রদাহের কারণে ব্যথা কমানোর জন্য গরম বা ঠাণ্ডা প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে। গরম সঙ্কোচন বা ঠাণ্ডা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- ধূমপান এবং মদ্যপান পরিহার: ধূমপান এবং মদ্যপান স্নায়ুপ্রদাহের সমস্যা আরও খারাপ করতে পারে, তাই এগুলি পরিহার করা উচিত।
- অটোইমিউন ডিজিজে চিকিত্সা: যদি স্নায়ুপ্রদাহ অটোইমিউন ডিজিজের কারণে হয়ে থাকে, তবে নির্দিষ্ট অটোইমিউন চিকিৎসা যেমন স্টেরয়েড বা ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হতে পারে।
- নিউরোপ্যাথি ম্যানেজমেন্ট: ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুপ্রদাহের ক্ষেত্রে, গ্লুকোজের স্তর নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দিষ্ট ডায়াবেটিক কেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
- অপারেশন বা সার্জারি: যদি স্নায়ুপ্রদাহ গুরুতর বা স্নায়ুর শিরা টিউমার দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ:
স্নায়ুপ্রদাহের লক্ষণগুলির ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি অনেক সময় গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। চিকিৎসক সঠিক পরীক্ষা করে সঠিক কারণ নির্ধারণ করে চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রস্তাব করবেন।