লিভার ক্যান্সার (Liver Cancer) হল এমন একটি অস্বাভাবিক এবং অসুস্থ কোষের বৃদ্ধি যা লিভারে ঘটে। এটি সাধারণত লিভারের প্রাথমিক ক্যান্সার হিসেবে শুরু হয়, তবে এটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা বেশ কঠিন। লিভার ক্যান্সার সাধারণত ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং সাধারণত অনেক সময় এটি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায় যখন রোগী বুঝতে পারেন।
কারণ:
লিভার ক্যান্সারের অনেক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে কিছু প্রধান কারণ হলো:
- হেপাটাইটিস ভাইরাস (Hepatitis B এবং C):
- দীর্ঘ সময় ধরে হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের সংক্রমণ লিভারের কার্যকারিতা বিঘ্নিত করতে পারে এবং ক্যান্সার তৈরি হতে পারে।
- সারোসিস (Cirrhosis):
- লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ বা ক্ষতি, যা সারোসিসে রূপান্তরিত হতে পারে। সারোসিস লিভারের কোষের স্থায়ী ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন:
- দীর্ঘমেয়াদি অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের ক্ষতি করে, যা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- লিভারের ফ্যাটি রোগ (Non-Alcoholic Fatty Liver Disease – NAFLD):
- ফ্যাটি লিভার রোগের কারণে লিভারে চর্বি জমে যায়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- জেনেটিক কারণ (Genetic factors):
- কিছু বংশগত কারণও লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
- কিছু রাসায়নিক বা বিষাক্ত পদার্থ:
- যেমন আফ্লাটক্সিন (Aflatoxins), যা ফাঙ্গাসের কারণে খাদ্যে তৈরি হতে পারে, লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা:
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা লিভার ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
- হেলথ কন্ডিশন:
- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং অন্যান্য কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
লক্ষণ:
লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে খুব বেশি স্পষ্ট হয় না, তবে কিছু লক্ষণ হতে পারে:
- পেটের উপর অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি:
- লিভারের কাছে ব্যথা বা পেট ফুলে যাওয়া অনুভূতি হতে পারে।
- পেট ফুলে যাওয়া:
- জল জমে পেট ফুলে যেতে পারে, যা “অ্যাসাইটিস” হিসেবে পরিচিত।
- চোখ এবং ত্বকে হলুদ আসা (জন্ডিস):
- লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার ফলে ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে হলুদ হয়ে যেতে পারে।
- খাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া:
- ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং দ্রুত তুষ্ট হয়ে যাওয়া।
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস:
- রোগী হঠাৎ ওজন কমাতে পারে, যা ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
- বমি, বমি ভাব বা দুর্বলতা:
- বমি, বমি ভাব, এবং শক্তি বা শক্তিহীনতা অনুভূতি হতে পারে।
- শরীরে অস্বাভাবিক ব্লিডিং বা কালচে দাগ:
- ক্যান্সারের কারণে শরীরে রক্তপাত হতে পারে, যেমন গামা বা মলদ্বারে রক্ত।
- নিবিড় ক্লান্তি:
- শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত বা দুর্বল অনুভব করতে পারে।
প্রতিকার:
লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের পর্যায়, ধরন এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর। কিছু চিকিৎসার উপায় হল:
- সার্জারি (অস্ত্রোপচার):
- ক্যান্সার যদি লিভারের একটি ছোট অংশে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সার্জারির মাধ্যমে সেই অংশ অপসারণ করা যেতে পারে।
- লিভার ট্রান্সপ্লান্ট:
- যদি ক্যান্সার লিভারের বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সার্জারি সম্ভব না হয়, তবে লিভার প্রতিস্থাপন (লিভার ট্রান্সপ্লান্ট) করা হতে পারে।
- কেমোথেরাপি (Chemotherapy):
- ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি থামাতে বা ধ্বংস করতে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এটি সিস্টেমিক চিকিৎসা যা শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োগ করা যায়।
- রেডিওথেরাপি (Radiotherapy):
- ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে উচ্চ শক্তির রেডিওতে চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে।
- টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy):
- এই ধরনের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করে তার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে বাধা দেওয়া হয়।
- ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy):
- রোগীর শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হতে পারে।
- পালিয়েটিভ কেয়ার:
- যদি ক্যান্সার পর্যাপ্ত উন্নত হয় এবং সারিয়ে তোলা সম্ভব না হয়, তবে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য পালিয়েটিভ কেয়ার দেওয়া হতে পারে।
প্রতিরোধ:
- হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন:
- হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নেওয়া যেতে পারে।
- অ্যালকোহল পরিহার করা:
- দীর্ঘমেয়াদী মদ্যপান এড়ানো উচিত, কারণ এটি লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য, নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ:
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা এবং স্থূলতা এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
- হেপাটাইটিস সি এবং বি ভাইরাস পরীক্ষা:
- সময়মতো হেপাটাইটিস ভাইরাসের পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করা।
লিভার ক্যান্সার শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে রোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।