মুখে মেস্তা (Mouth ulcers) বা মুখের ঘা হলো মুখের ভেতরের ত্বক বা মিউকোসা (mucosa) অংশে তৈরি হওয়া ছোট ঘা বা ক্ষত। এটি খুবই সাধারণ একটি সমস্যা এবং সাধারণত ব্যথাযুক্ত হতে পারে, বিশেষ করে খাওয়ার সময় বা কথা বলার সময়। মেস্তা সাধারণত ছোট হয় এবং কয়েক দিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়, তবে কখনও কখনও এটি বার বার হতে পারে এবং বেশ কষ্টকর হতে পারে।
মুখে মেস্তার কারণ:
- আঘাত বা চোট: মুখে খাবার খাওয়ার সময় দাঁতের কোন তীক্ষ্ণ অংশ বা শক্ত কিছু দিয়ে ত্বকে আঘাত লাগলে তা ঘা হতে পারে। এছাড়া দাঁতের ব্রাশ বা মেকআপের ফলে ক্ষত হতে পারে।
- স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ: অতিরিক্ত স্ট্রেস বা মানসিক চাপও মুখে মেস্তা সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত তীব্র বা খিটখিটে খাবার খাওয়ার ফলে, যেমন মশলাদার খাবার, লেবু বা টমেটো, বা অতিরিক্ত গরম খাবার মুখে ঘা তৈরি করতে পারে।
- ভিটামিন বা মিনারেলের অভাব: ভিটামিন B12, ফোলেট (Folate), আয়রন, বা ভিটামিন C এর অভাব থাকলে মুখে ঘা হতে পারে। বিশেষত, যারা সুষম খাদ্য গ্রহণ করেন না তাদের মাঝে এটি বেশি দেখা যায়।
- হরমোনাল পরিবর্তন: মাসিক বা গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মুখে মেস্তা হতে পারে।
- সংক্রামক রোগ: কিছু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও মুখের ঘা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, হির্পিস সিম্পলেক্স ভাইরাস (Herpes simplex virus) বা অন্য ভাইরাস সংক্রমণ।
- অ্যালার্জি: কিছু খাবার বা উপাদানের প্রতি অ্যালার্জি থাকলে তাও মুখে ঘা সৃষ্টি করতে পারে।
- অটোইমিউন রোগ: কিছু অটোইমিউন রোগ যেমন লুপাস বা কোলাইটিস এর কারণেও মুখে ঘা হতে পারে।
- পানি বা ঘুমের অভাব: পর্যাপ্ত পানি না পান করা এবং কম ঘুম, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে, মুখের ঘা সৃষ্টি করতে পারে।
মুখে মেস্তার লক্ষণ:
- লালচে বা সাদা ঘা: মুখের মিউকোসা বা ঠোঁটের ভিতর ছোট ছোট সাদা বা লালচে রঙের ঘা দেখা যায়, যা সাধারণত বেদনাদায়ক হয়।
- ব্যথা: ঘা সাধারণত খাওয়ার সময় বা কথা বলার সময় ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
- ফোলা: ঘার চারপাশে ত্বক ফুলে যেতে পারে।
- খাওয়ার সমস্যা: ঘার কারণে খাবার খেতে কষ্ট বা ব্যথা হতে পারে, বিশেষত মশলাদার বা টক খাবার খাওয়ার সময়।
- সাধারণ ক্লান্তি: যদি মেস্তা বার বার হয় বা খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আপনি ক্লান্তি বা সামান্য জ্বরও অনুভব করতে পারেন।
মুখে মেস্তার প্রতিকার:
- মুখ পরিষ্কার রাখা: নিয়মিত মুখ পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত দু’বার একটি নরম টুথব্রাশ এবং নরম দাঁত পরিষ্কার করার পেস্ট ব্যবহার করুন।
- গরম লবণ পানির গার্গল (Gargle): এক কাপ গরম পানিতে ১ চা চামচ লবণ মিশিয়ে দিয়ে, দিনে ৩-৪ বার গার্গল করুন। এটি সংক্রমণ দূর করতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে।
- মৌথ গেল (Mouth Gel): বাজারে কিছু মৌথ গেল রয়েছে যা ঘার ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং এটি ত্বককে দ্রুত আরোগ্য করে তোলে। বিশেষত, গেলের মধ্যে বেনজোকেন বা হাইড্রোকোর্টিজোন থাকার কারণে এটি দ্রুত আরাম দেয়।
- ওষুধ (Pain Relievers): যদি ঘার ব্যথা সহ্য করার মতো না হয়, তবে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক ব্যবহার করতে পারেন, তবে এগুলি ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- ভিটামিন এবং মিনারেল সাপ্লিমেন্ট: যদি ভিটামিন B12, আয়রন বা ভিটামিন C এর অভাব থাকে, তবে খাদ্যতালিকায় এসব ভিটামিনের সাপ্লিমেন্ট যুক্ত করা যেতে পারে।
- অ্যান্টি–অ্যালার্জি মেডিসিন: যদি অ্যালার্জির কারণে মেস্তা হয়, তবে অ্যান্টি-হিস্টামিন ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
- ঠান্ডা পানীয় বা বরফ ব্যবহার: ঘার ব্যথা কমাতে ঠান্ডা পানীয় বা বরফের টুকরা মুখে রাখাও কার্যকর হতে পারে। তবে এটি কেবল সাময়িক আরাম দেয়।
- হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস: কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন হলুদ, আলোভেরা, বা মধু ত্বকের অরোহার জন্য উপকারী হতে পারে। আলোভেরা গাছের রস ঘায় এর উপরে লাগিয়ে দিন, যা ব্যথা কমাতে সহায়ক।
মুখে মেস্তার প্রতিরোধ:
- সুষম খাদ্য গ্রহণ: পর্যাপ্ত ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যেমন শাকসবজি, ফল, এবং দুধজাত খাবার খাওয়া।
- স্ট্রেস কমানো: স্ট্রেস কমানোর জন্য যোগব্যায়াম বা ধ্যান করতে পারেন।
- পর্যাপ্ত পানি পান করা: পানি খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখা, যা ত্বক এবং সারা শরীরের সুস্থতা বজায় রাখে।
- দাঁত ও মুখের ভালো যত্ন: নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার রাখা, দাঁতের মেম্বার পরিবর্তন এবং মাউথওয়াশ ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- অতীত ঘা থেকে সজাগ থাকা: যাদের মুখে বার বার মেস্তা হয়, তারা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নিন।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:
- যদি মেস্তা দীর্ঘদিন ধরে না সারে বা খুব বড় হয়ে যায়।
- যদি ঘার আকারে পরিবর্তন ঘটে, যেমন লালচে হয়ে গিয়ে ফুলে যায়।
- যদি ঘার সাথে কোনো ফোলা বা সংক্রমণ দেখা দেয়।
- যদি ত্বকে জ্বর বা ক্লান্তি অনুভূত হয়।
মুখে মেস্তা সাধারণত তেমন কোন বড় সমস্যা না হলেও, যদি এটি বার বার হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।