মুখে টিউমার (Mouth Tumor) হল মুখের মধ্যে বা এর আশেপাশের অঞ্চলে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি। এটি সাধারণত বিনাইন (benign) বা ম্যালিগন্যান্ট (malignant) হতে পারে। মুখে টিউমার অনেক ধরনের হতে পারে, যেমন মুখের শ্লেষ্মা ঝিল্লি, মাড়ি, জিহ্বা, ঠোঁট, ত্বক, দাঁত, বা মুখের পেশি বা হাড়ে টিউমার হতে পারে। কিছু সাধারণ মুখের টিউমারের মধ্যে অরাল ক্যান্সার (oral cancer), ফাইব্রোমা, মুকোসেল (mucocele), গ্যাংলিয়ন সিস্ট (ganglion cyst) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
মুখে টিউমারের কারণ:
মুখে টিউমার হতে পারে বিভিন্ন কারণে, এর মধ্যে বেশ কিছু সাধারণ কারণ:
- অতিরিক্ত তামাক ও অ্যালকোহল সেবন:
- দীর্ঘদিন ধরে তামাক বা সিগারেট পান করার কারণে মুখের কোষে পরিবর্তন আসতে পারে, যা টিউমারের সৃষ্টি করতে পারে। তামাক বা অ্যালকোহল ব্যবহার অরাল ক্যান্সার হতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
- অপর্যাপ্ত পুষ্টি, বিশেষ করে ভিটামিন A এবং C এর অভাব, মুখের টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- ভাইরাল সংক্রমণ:
- হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) সংক্রমণও মুখের ক্যান্সার বা টিউমার তৈরি করতে পারে। এটি বিশেষভাবে জিহ্বা, গলা, ঠোঁটের ভিতরে প্রভাব ফেলতে পারে।
- জেনেটিক কারণ:
- কিছু লোকের মধ্যে বংশগতভাবে মুখের টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
- বিভিন্ন প্রকার আঘাত বা ইনফেকশন:
- মুখে আঘাত বা ধারালো বস্তু দিয়ে কেটে গেলে বা অতিরিক্ত চাপের কারণে কোষে পরিবর্তন হতে পারে, যা পরে টিউমার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও মুখের ইনফেকশন থেকেও টিউমার তৈরি হতে পারে।
- অতিরিক্ত সুর্যের রশ্মির সংস্পর্শ:
- দীর্ঘদিন সূর্যের রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে মুখের ত্বকে ক্যান্সার বা টিউমার সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে ঠোঁটের আশপাশে।
মুখে টিউমারের লক্ষণ:
মুখের টিউমারের লক্ষণগুলি তার ধরণ, আকার এবং অবস্থান অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হতে পারে:
- মুখের ভিতরে বা বাইরের অস্বাভাবিক গুটি বা পিণ্ড:
- মুখের মধ্যে বা বাইরে, যেমন ঠোঁটের ভিতরে, মাড়ি, জিহ্বায়, অথবা চোয়াল বা ঠোঁটের বাইরের দিকে গুটি বা টিউমার দেখা দিতে পারে।
- মুখে ব্যথা বা অস্বস্তি:
- মুখের ভিতরে বা আশেপাশে টিউমার থাকলে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। বিশেষত দাঁত মাজার সময় বা খাবার খাওয়ার সময় এটি ব্যথা তৈরি করতে পারে।
- মুখের রক্তপাত:
- টিউমার থেকে রক্তপাত হতে পারে, বিশেষত যদি এটি মাড়ি বা দাঁতের পাশে থাকে। এতে হালকা বা তীব্র রক্তপাত হতে পারে।
- মুখের ভিতরে সাদা বা লাল দাগ:
- লেভোপ্লাকিয়া (Leukoplakia) বা এরিথ্রোপ্লাকিয়া (Erythroplakia) নামক সাদা বা লাল দাগ মুখের ভিতরে বা ঠোঁটের আশেপাশে দেখা দিতে পারে, যা মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
- মুখে খাবার খেতে বা কথা বলতে সমস্যা:
- মুখের ভিতরে টিউমার থাকলে খাবার খাওয়ার সময় বা কথা বলার সময় সমস্যা হতে পারে, যেমন কষ্টে কথা বলা বা খাওয়ার সময় অস্বস্তি।
- দাঁত বা চোয়াল সরে যাওয়া:
- মুখের টিউমার বা ক্যান্সারের কারণে দাঁত বা চোয়ালের পরিবর্তন বা সরে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
- মুখে গন্ধ বা ইনফেকশন:
- ইনফেকশন বা টিউমারের কারণে মুখে দুর্গন্ধ আসতে পারে এবং এটি তীব্র হতে পারে।
মুখে টিউমারের প্রতিকার:
মুখের টিউমারের চিকিৎসা তার ধরণ এবং অবস্থার উপর নির্ভর করে। যদি টিউমারটি বিনাইন (benign) হয়, তবে এটি সাধারণত সার্জারির মাধ্যমে অপসারণযোগ্য। তবে যদি টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট (malignant) বা ক্যান্সারের রূপ ধারণ করে, তাহলে চিকিৎসার জন্য আরও গুরুতর ব্যবস্থা নিতে হয়। কিছু সাধারণ চিকিৎসার পদ্ধতি:
- সার্জারি (Surgery):
- অনেক ক্ষেত্রে, টিউমার অপসারণের জন্য সার্জারি করা হয়। এটি একটি সাধারণ পদ্ধতি, বিশেষ করে যদি টিউমারটি ছোট বা এক জায়গায় থাকে। কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি অপসারণ করা হয়।
- কেমোথেরাপি (Chemotherapy):
- যদি টিউমারটি ক্যান্সার জাতীয় হয়, তবে কেমোথেরাপি দেওয়া হতে পারে, যা টিউমারের কোষগুলিকে ধ্বংস করে।
- রেডিওথেরাপি (Radiotherapy):
- মুখে ক্যান্সার হলে, টিউমারের কোষ ধ্বংস করতে রেডিওথেরাপি বা তেজস্ক্রিয় চিকিত্সা প্রয়োগ করা হতে পারে।
- ওষুধ (Medications):
- কিছু পরিস্থিতিতে, মুখের টিউমারের কারণে ব্যথা বা প্রদাহ হলে, বিশেষ ধরনের ব্যথানাশক বা প্রদাহনাশক ওষুধ দেওয়া হতে পারে।
- অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি (Antibiotic Therapy):
- মুখে ইনফেকশন হলে এবং রক্তপাত বা ক্ষত দেখা দিলে, ইনফেকশন থেকে রক্ষা পেতে অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- ফিজিওথেরাপি (Physiotherapy):
- যদি মুখের টিউমার অপসারণের পর কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা থাকে, যেমন কথা বলা বা খাওয়ার সমস্যা, তবে ফিজিওথেরাপি পরামর্শ করা হতে পারে।
- মুখের স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা:
- মুখের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর জন্য দাঁত ব্রাশ করা, নিয়মিত মাড়ি পরিষ্কার রাখা, এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা মুখের টিউমার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
প্রতিরোধ:
মুখে টিউমার হওয়ার কিছু কারণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে, যেমন:
- তামাক ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা:
- তামাক ও অ্যালকোহল সেবন মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, তাই এসব থেকে দূরে থাকা উচিত।
- নিয়মিত মুখের স্বাস্থ্যপরীক্ষা:
- নিয়মিত দন্তচিকিৎসক বা মুখের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং মুখের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা টিউমারের দ্রুত শনাক্তকরণের জন্য সহায়ক হতে পারে।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া:
- মুখে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক দাগ বা সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ করা উচিত।
- ভাইরাল সংক্রমণ থেকে রক্ষা:
- HPV বা অন্য ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে সতর্কতা অবলম্বন করা, যেমন টিকা নেওয়া, যা মুখের ক্যান্সার কমাতে সাহায্য করতে পারে।
শেষ কথা:
মুখে টিউমার, বিশেষত ক্যান্সার, খুবই গুরুতর হতে পারে, তবে প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক চিকিত্সা নেওয়া হলে এর চিকিৎসা সম্ভব। যদি মুখে কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন গুটি, ব্যথা, বা ইনফেকশন, তবে তৎকালীন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।