মুখেক্ষত (Mouth Ulcers) হলো মুখের মধ্যে ছোট ছোট ক্ষত বা দানা যা সাধারণত ঠোঁট, মাড়ি, জিভ বা মুখের ভেতরের অংশে হয়ে থাকে। এটি সাধারণত বেশিরভাগ মানুষের জন্য অস্বস্তিকর এবং ব্যথাযুক্ত হতে পারে, তবে এটি সাধারণত গুরুতর কোনো রোগ নয়।
কারণ:
মুখেক্ষতের কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে, যেমন:
- স্ট্রেস বা মানসিক চাপ:
- মানসিক চাপ বা উদ্বেগ মুখের ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করতে পারে, ফলে মুখে ক্ষত সৃষ্টি হয়।
- খাদ্য উপাদান বা অ্যালার্জি:
- কিছু খাবারের প্রতি অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা যেমন টমেটো, সাইট্রাস ফল (লেবু, কমলা), মশলাদার বা তেতো খাবার মুখে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
- মুখের সংক্রমণ বা ভাইরাস:
- হারপিস ভাইরাস (Herpes simplex virus) এর সংক্রমণ মুখের ক্ষতের কারণ হতে পারে, যা সাধারণত ঠোঁটের কাছাকাছি বা মুখের ভিতরে দেখা যায়।
- আঘাত বা চাপ:
- মুখে কোনো দুর্ঘটনা বা আঘাতের কারণে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। যেমন দাঁতের ব্রাশ করার সময় অযত্নে মুখে আঘাত লাগা।
- ভিটামিনের অভাব:
- বিশেষ করে ভিটামিন বি১২, ফোলেট, আয়রন এবং ভিটামিন সি এর অভাব মুখে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
- হরমোনের পরিবর্তন:
- মহিলাদের গর্ভাবস্থা বা মাসিকের সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মুখে ক্ষত দেখা দিতে পারে।
- পেটের সমস্যা:
- পেটের অস্বস্তি, যেমন গ্যাস্ট্রিক বা হজমের সমস্যা, বা অন্ত্রের রোগ (যেমন কোলাইটিস) মুখে ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে।
- প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যা:
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে বা অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হলে (যেমন, লুপাস, সিওরিয়াটিক আথ্রাইটিস), মুখে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে।
- মুখের শুষ্কতা:
- মুখের শুষ্কতা, বিশেষ করে অতিরিক্ত ডিহাইড্রেশন বা স্যালিভারি গ্ল্যান্ডের সমস্যার কারণে, মুখে ক্ষত তৈরি হতে পারে।
লক্ষণ:
মুখক্ষেতের লক্ষণগুলি নিম্নরূপ হতে পারে:
- ব্যথা:
- মুখের ক্ষত সাধারণত ব্যথাযুক্ত হয়, যা খাবার বা পানীয় খাওয়ার সময় আরও তীব্র হতে পারে।
- লাল ও ফোলা অংশ:
- ক্ষতটি সাধারণত লাল এবং ফুলে থাকা থাকতে পারে।
- ছোট দানা বা ফুসকুড়ি:
- ক্ষতটি ছোট গোলাকার বা ছোট ফুসকুড়ির মতো হতে পারে। এগুলি সাদা বা হলুদ রঙের হয়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে সোজা ত্বক থেকে কিছুটা উঁচু হতে পারে।
- শুষ্কতা ও জ্বালা:
- মুখের ভেতর বা ঠোঁটে শুষ্কতা বা জ্বালাপোড়া অনুভূতি থাকতে পারে।
- ক্ষত বৃদ্ধি:
- কিছু ক্ষেত্রে, ক্ষত বা দানা বৃহত্তর হতে পারে এবং একাধিক ক্ষত একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করতে পারে।
- খাবার ও পানীয় খেতে অসুবিধা:
- ক্ষতযুক্ত অংশের কারণে খাবার ও পানীয় খেতে সমস্যা হতে পারে, বিশেষত টক, মশলাদার বা গরম খাবার খাওয়ার সময়।
প্রতিকার:
মুখক্ষেতের জন্য বেশ কিছু প্রতিকার রয়েছে, যা উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে:
- মুখ পরিষ্কার রাখা:
- মুখে ক্ষত হওয়া স্থানে কোনো ধরনের ইনফেকশন যাতে না হয়, সেজন্য নিয়মিত মাউথওয়াশ বা গরম পানিতে নুন গুলে দিয়ে গার্গল করা যেতে পারে।
- মৌখিক ব্যথানাশক:
- কিছু অ্যান্টিসেপ্টিক মাউথওয়াশ বা পেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
- গরম পানিতে নুন গার্গল:
- গরম পানিতে নুন গুলে গার্গল করলে মুখের প্রদাহ কমে এবং ক্ষত শীঘ্র সুস্থ হতে পারে।
- ভিটামিন সি ও বি১২ সমৃদ্ধ খাবার:
- ভিটামিন সি, ভিটামিন বি১২, আয়রন এবং ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার খেলে মুখের ক্ষত দ্রুত সুস্থ হতে পারে। যেমন: সাইট্রাস ফল, শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি।
- ওষুধ ও ক্রিম ব্যবহার:
- চিকিৎসক নির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য কিছু অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বা অ্যানালজেসিক (ব্যথা উপশমকারী) ক্রিমও দিতে পারেন।
- মুখের আর্দ্রতা বজায় রাখা:
- মুখ শুষ্কতা থেকে রক্ষা করতে প্রচুর পানি পান করা উচিত। এছাড়া, যদি প্রয়োজন হয়, ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মনে চাপ কমানো:
- স্ট্রেস বা উদ্বেগের কারণে যদি ক্ষত সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে কিছু শিথিলকরণ পদ্ধতি, যেমন যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, বা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া সাহায্য করতে পারে।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা:
- ধূমপান বা অ্যালকোহল মুখের শুষ্কতা সৃষ্টি করতে পারে, যা ক্ষতকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এসব থেকে বিরত থাকাই ভাল।
- ডাক্তারের পরামর্শ:
- যদি ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হয়, অথবা ঘন ঘন হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক কিছু শক্তিশালী চিকিৎসা বা মলমের পরামর্শ দিতে পারেন।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত:
- যদি ক্ষত অনেক বড় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
- যদি তীব্র ব্যথা থাকে বা আঘাতের পর সংক্রমণ দেখা দেয় (যেমন পুঁজ, লালভাব, বা অস্বাভাবিক গন্ধ)।
- যদি মুখের ক্ষত প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে যায় বা ঘন ঘন হয়।
- যদি কোনো অ্যালার্জি বা ইমিউন সিস্টেমের সমস্যা থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
উপসংহার:
মুখক্ষত সাধারণত অস্থায়ী এবং স্বাভাবিকভাবে সুস্থ হয়ে যায়। তবে সঠিক যত্ন এবং কিছু ঘরোয়া প্রতিকার প্রয়োগ করলে এটি দ্রুত সারতে সাহায্য করতে পারে