বেরিবেরি (Beriberi) একটি নিউরোলজিক্যাল রোগ যা মূলত ভিটামিন বি১ (থিয়ামিন) এর অভাবজনিত রোগ। থিয়ামিন আমাদের শরীরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, বিশেষত শক্তির উৎপাদন এবং স্নায়ু সিস্টেমের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। থিয়ামিনের অভাব হলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে অন্যতম বেরিবেরি।
কারণ:
বেরিবেরি হওয়ার প্রধান কারণ হল থিয়ামিনের (ভিটামিন B1) অভাব। এই অভাব সাধারণত কয়েকটি কারণে হতে পারে:
- অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ: যদি খাদ্যতালিকায় থিয়ামিন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ কম থাকে, যেমন চাল, সাদা ভাত, অত্যধিক প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তেল-মশলা মিশ্রিত খাবার, তাহলে শরীরে থিয়ামিনের অভাব দেখা দিতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: যদি খাদ্য সুস্থ না হয় বা একক ধরনের খাদ্য (যেমন শুধু শ্বেত চাল বা সাদা ভাত) খাওয়া হয়, তবে থিয়ামিনের অভাব হতে পারে।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান: অ্যালকোহল বেশি খাওয়া হলে থিয়ামিন শোষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে শরীরে থিয়ামিনের ঘাটতি দেখা দেয়।
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাগুলি: কিছু লোকের জন্য অন্ত্রের সমস্যার কারণে বা অপুষ্টি রোগের কারণে থিয়ামিন শোষণ কম হতে পারে।
- গর্ভাবস্থা ও দুধ খাওয়ানো: গর্ভাবস্থায় বা দুধ খাওয়ানোর সময় মহিলা থিয়ামিনের অভাবে আক্রান্ত হতে পারেন, কারণ তারা নিজের শরীরের মাধ্যমে সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় থিয়ামিন সরবরাহ করেন।
লক্ষণ:
বেরিবেরির লক্ষণগুলো সাধারণত শরীরে শক্তির অভাব, স্নায়ুজনিত সমস্যা এবং শারীরিক দুর্বলতা তৈরি করে। এই রোগটি দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে:
১. ড্রাই বেরিবেরি (Dry Beriberi):
এটি স্নায়ু সিস্টেমের ক্ষতি ঘটায় এবং মাংসপেশীতে দুর্বলতা, প্যারালাইসিস এবং অন্যান্য স্নায়ু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- পেশী দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত: শরীরের পেশীগুলি দুর্বল হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে হাত-পা বা পায়ে।
- পা বা পায়ের পেশী কাঁপানো: সাধারণত পা এবং পায়ের পেশীতে কাঁপুনি বা দুর্বলতা দেখা দেয়।
- হাঁটা চলায় সমস্যা: হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
- মাংসপেশীর ব্যথা: শরীরের বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশীতে ব্যথা অনুভূত হয়।
২. উইট বেরিবেরি (Wet Beriberi):
এটি মূলত হৃদরোগ এবং রক্তনালী সংক্রান্ত সমস্যাগুলির কারণ হয়ে থাকে।
- হৃদরোগের লক্ষণ: হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যাওয়া (টেক্কার্ডিয়া), হৃদপিণ্ডের অসুস্থতা এবং শ্বাসকষ্ট।
- এডেমা বা ফোলা পা: পায়ে বা শরীরের অন্যান্য অংশে ফোলা দেখা দিতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট: শরীরের মধ্যে তরল জমে গিয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে।
- অন্য অঙ্গের ক্ষতি: এ ধরনের বেরিবেরিতে কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৩. অপরিপক্ব বেরিবেরি (Infantile Beriberi):
এটি বিশেষভাবে ছোট শিশুদের মধ্যে হতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের মা থিয়ামিনের অভাবে ভুগছেন এবং শিশুকে পর্যাপ্ত থিয়ামিন না দেওয়া হয়।
- শিশুর খিঁচুনি বা স্নায়ু সমস্যা।
- শিশুর শক্তি ও ঘুমের সমস্যা।
প্রতিকার:
বেরিবেরি পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য একটি রোগ। থিয়ামিনের অভাব মেটানোর মাধ্যমে এটি নিরাময় করা যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার হলো:
- থিয়ামিন সাপ্লিমেন্ট:
- থিয়ামিন সাপ্লিমেন্ট (ভিটামিন B1) গ্রহণ করা, যা রোগীর শরীরে দ্রুত থিয়ামিনের অভাব পূর্ণ করতে সহায়ক।
- থিয়ামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া:
- শস্যদানা (ব্রাউন রাইস, পূর্ণ শস্য), মাংস (বিশেষত শুকরের মাংস), ডাল, সবজি, আলু, ডিম, এবং বাদাম—এই ধরনের খাবার থিয়ামিনের ভাল উৎস।
- অ্যালকোহল পরিহার:
- অ্যালকোহল অতিরিক্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, কারণ এটি থিয়ামিন শোষণ বাধাগ্রস্ত করে।
- বেশি খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়া:
- ভাল খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে শরীরের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি গ্রহণ করা। একে বলা হয় ব্যালান্সড ডায়েট।
- প্রাথমিক চিকিৎসা:
- বেরিবেরি ধরা পড়লে দ্রুত থিয়ামিন সাপ্লিমেন্ট বা ইনজেকশন প্রয়োগ করা উচিত, যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হয়।
- গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টি:
- গর্ভবতী মহিলা বা দুধ খাওয়ানো মায়েরা প্রচুর পুষ্টি গ্রহণ করুন, যাতে তাদের শরীরে যথেষ্ট থিয়ামিন থাকে।
প্রতিরোধ:
- থিয়ামিন সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
- অ্যালকোহল এবং তেল–মশলা কম খাওয়া, যাতে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি ঠিকভাবে শোষিত হয়।
- শিশুদের জন্য বিশেষ যত্ন: গর্ভাবস্থায় মা যদি পর্যাপ্ত থিয়ামিন গ্রহণ করেন, তবে শিশুরাও এতে উপকৃত হবে।