বাত জ্বর (Rheumatic Fever) একটি প্রদাহজনিত রোগ, যা সাধারণত গলাব্যথা বা অ্যাঞ্জাইনা (Strep Throat) থেকে শুরু হয় এবং এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত হৃদপিণ্ড, যথেষ্ট কোণ বা জয়েন্ট এবং ত্বক। এই রোগটি মূলত স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে, যা গলা বা থ্রোটের ইনফেকশন সৃষ্টি করে। যদি গলা বা ঠোঁটে ব্যথা হলে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এই ব্যাকটেরিয়া শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে গিয়ে বাত জ্বরের সৃষ্টি করতে পারে।
বাত জ্বরের কারণ:
বাত জ্বরের প্রধান কারণ হলো স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণ, যা সাধারণত গলা বা অ্যাঞ্জাইনা (স্ট্রেপ গলা ইনফেকশন) থেকে শুরু হয়। যখন গলার ইনফেকশন যথাযথভাবে চিকিৎসা করা হয় না, তখন এই ইনফেকশন শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে জয়েন্ট, হৃদপিণ্ড, ত্বক এবং স্নায়ু ব্যবস্থায়। বাত জ্বর সাধারণত ৫-১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
বাত জ্বরের লক্ষণ:
বাত জ্বরের লক্ষণগুলি সাধারণত গলা ব্যথা (Strep Throat) থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রধান লক্ষণগুলো হল:
- গলা বা অ্যাঞ্জাইনা (Throat Pain):
- গলা ব্যথা এবং গলায় লালচে বা ফোলাভাব হতে পারে। এটি মূলত স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়।
- যৌথ ব্যথা (Joint Pain):
- বাত জ্বরের কারণে হাঁটু, কনুই বা কবজ জয়েন্টে ব্যথা এবং ফোলাভাব হতে পারে। সাধারণত এই ব্যথা হঠাৎ করে চলে যায় এবং অন্য জয়েন্টে চলে যেতে পারে।
- হৃদপিণ্ডের সমস্যা (Heart Problems):
- বাত জ্বরের কারণে হৃদপিণ্ডের অন্তর্গত টিস্যুতে প্রদাহ হতে পারে, যার ফলে রিউমাটিক হার্ট ডিজিজ (Rheumatic Heart Disease) হতে পারে।
- এর ফলে হার্টের ভালভে সমস্যা দেখা দেয় এবং অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হতে পারে।
- শরীরে ফোলাভাব (Edema or Swelling):
- শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে পা বা হাতের জয়েন্টে।
- র্যাশ (Rash):
- রোগীকে একটি রোজার র্যাশ (Erythema Marginatum) হতে পারে, যা ত্বকের উপর লাল বা গোলাকার দাগের মতো দেখা যায়।
- নাচন বা টিক (Chorea):
- কিছু রোগী নাচন বা অস্বাভাবিক আন্দোলন অনুভব করে, যা সাধারণত হাত বা পায়ে দেখা যায়।
- জ্বর:
- বাত জ্বরের সঙ্গে সাধারণত জ্বর থাকে, যা শরীরের তাপমাত্রা ১০০-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।
- দুর্বলতা বা ক্লান্তি:
- রোগীর শরীরে দুর্বলতা, ক্লান্তি বা অস্থিরতা দেখা যেতে পারে।
বাত জ্বরের প্রতিকার:
বাত জ্বরের চিকিৎসা সময়মতো শুরু করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভবিষ্যতে গুরুতর হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে:
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা:
- প্রথমেই স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া নিরাময় করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা দিতে হবে। এটি গলার ইনফেকশনকে দূর করে এবং বাত জ্বরের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- সাধারণত পেনিসিলিন বা অ্যামোক্সিসিলিন দেওয়া হয়।
- দীর্ঘমেয়াদি অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
- কিছু ক্ষেত্রে, বাত জ্বরের পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ৫-১০ বছর পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিকের রক্ষাকারী ডোজ দেওয়া হতে পারে।
- প্রদাহ কমানোর ওষুধ:
- অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (যেমন ইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন) জয়েন্টে প্রদাহ কমাতে এবং ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে।
- হৃদপিণ্ডের চিকিৎসা:
- যদি হৃদপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়মিত পরামর্শ দেবেন। প্রয়োজনে হৃদপিণ্ডের জন্য আরও চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে, যেমন হৃদযন্ত্রের ভালভ সমস্যা বা হার্ট ডিজিজের জন্য।
- বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত জলপান:
- শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া এবং পর্যাপ্ত জলপান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে শরীরের সিস্টেমটি সুস্থ থাকে এবং শক্তি ফিরে আসে।
- গোলযোগ এবং দুর্বলতা কাটানোর জন্য সাইকোলজিক্যাল সহায়তা:
- কিছু রোগী দীর্ঘ সময়ের জন্য শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন, এবং তাদের জন্য মানসিক সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধ:
বাত জ্বরের প্রতিরোধের জন্য স্ট্রেপ্টোকক্কাল গলা সংক্রমণের চিকিত্সা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হল:
- গলা ব্যথা বা অ্যাঞ্জাইনা হলে চিকিৎসা করা: গলার ব্যথা বা সংক্রমণ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা: গলা ব্যথা বা স্ট্রেপ গলা ইনফেকশন ধরা পড়লে চিকিৎসক নির্দেশিত অ্যান্টিবায়োটিক সম্পূর্ণভাবে নেওয়া উচিত।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত বিশ্রাম এবং শরীরচর্চা করা, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- সামাজিক দূরত্ব: সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমাতে অপরিচিত বা অসুস্থ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলা উচিত।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- যদি গলায় ব্যথা থাকে এবং তাতে গলাযুক্ত ফোলা বা সাদা দাগ দেখা দেয়।
- যদি গলা ব্যথার পর জয়েন্টে বা শরীরে ফোলাভাব বা ব্যথা অনুভব হয়।
- যদি হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয় বা বুকের ব্যথা অনুভূত হয়।
- যদি র্যাশ বা টিক (Chorea) দেখা দেয়।
বাত জ্বর একটি গুরুতর রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে হৃদরোগ সহ নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া এবং সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।