বহুমূত্র (Polyuria) হলো একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি অস্বাভাবিকভাবে অনেক পরিমাণে প্রস্রাব করে। সাধারণত, দৈনিক ১.৫ থেকে ২ লিটার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যদি এটি ৩ লিটার বা তার বেশি হয়, তাহলে সেটি বহুমূত্র হিসেবে গণ্য হয়। বহুমূত্রের কারণে শরীরে জল ও লবণের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে এবং এটি অনেক শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বহুমূত্রের কারণ:
- ডায়াবেটিস মেলিটাস (Diabetes Mellitus):
- কারণ: ডায়াবেটিসে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত শর্করা মূত্রের মাধ্যমে বের হয়ে যায়, যা মূত্রের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
- লক্ষণ: অতিরিক্ত তেষ্টা, অস্বাভাবিক ক্ষুধা, এবং ক্লান্তি।
- ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস (Diabetes Insipidus):
- কারণ: এই রোগে মস্তিষ্কে থাকা এন্টিডিউরেটিক হরমোন (ADH) এর ঘাটতি বা তার কার্যকারিতায় সমস্যা ঘটে, যার ফলে মূত্রাশয় থেকে অতিরিক্ত পানি বের হয়।
- লক্ষণ: অত্যধিক তেষ্টা, মূত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি, এবং ঘন ঘন প্রস্রাব।
- বেশি তরল গ্রহণ (Excessive Fluid Intake):
- কারণ: যদি কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে পানি, চা, কফি বা অন্য তরল পান করে, তবে এটি বহুমূত্র সৃষ্টি করতে পারে।
- লক্ষণ: প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি, বিশেষত রাতে বেশি প্রস্রাব।
- হাইপারক্যালসেমিয়া (Hypercalcemia):
- কারণ: শরীরে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম থাকলে এটি মূত্রাশয়ে অতিরিক্ত পানি নির্গত করতে সাহায্য করে, যার ফলে বহুমূত্র হতে পারে।
- লক্ষণ: ক্লান্তি, শরীরে দুর্বলতা, এবং অস্বাভাবিক ক্ষুধা।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- কারণ: কিছু ওষুধ যেমন ডায়ুরেটিকস (Diuretics) মূত্রাশয়ে পানি সরানোর পরিমাণ বাড়াতে পারে, যার ফলে বহুমূত্র হতে পারে।
- লক্ষণ: ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত পানি খাওয়ার প্রয়োজন।
- কিডনি সমস্যা (Kidney Disorders):
- কারণ: কিডনির যেকোনো ধরনের অসুস্থতা, যেমন কিডনি ব্যর্থতা, কিডনির সিস্ট, বা অন্যান্য কিডনি সমস্যা, মূত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করতে পারে এবং মূত্রের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
- লক্ষণ: শরীরে ফোলাভাব, ক্লান্তি, এবং প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য কিডনি সম্পর্কিত লক্ষণ।
- অতিরিক্ত ক্যাফিন বা অ্যালকোহল গ্রহণ:
- কারণ: ক্যাফিন বা অ্যালকোহল সেবন মূত্রাশয়ের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, যা মূত্র উৎপাদন বাড়াতে পারে।
- লক্ষণ: ঘন ঘন প্রস্রাব, বিশেষত ক্যাফিন বা অ্যালকোহল সেবনের পরে।
- গর্ভাবস্থা (Pregnancy):
- কারণ: গর্ভাবস্থায়, মূত্রাশয়ে চাপ পড়ে এবং মূত্রের পরিমাণ বাড়তে পারে, বিশেষ করে প্রাথমিক তিন মাসে।
- লক্ষণ: প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি, বিশেষত রাতে।
বহুমূত্রের লক্ষণ:
- অতিরিক্ত প্রস্রাব: ব্যক্তির প্রাত্যহিক প্রস্রাবের পরিমাণ ৩ লিটার বা তার বেশি হয়ে যেতে পারে।
- অতিরিক্ত তেষ্টা বা পানির প্রতি আকর্ষণ: শরীরে পানির অভাব পূরণ করতে বেশি পানি বা তরল পান করার প্রবণতা।
- ঘন ঘন প্রস্রাব: বিশেষ করে রাতে (নক্টুরিয়া) ঘন ঘন প্রস্রাবের অনুভূতি।
- ক্লান্তি এবং দুর্বলতা: শর্করা বা অন্যান্য লবণের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে ক্লান্তি অনুভূতি হতে পারে।
- শরীরে ফোলাভাব বা জল জমা: কিডনি বা অন্যান্য সমস্যার কারণে শরীরে অতিরিক্ত জল জমতে পারে।
বহুমূত্রের প্রতিকার:
- ডায়াবেটিসের চিকিৎসা: যদি ডায়াবেটিসের কারণে বহুমূত্র হয়, তাহলে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ইনসুলিন বা অন্যান্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ নিতে হবে।
- এন্টিডিউরেটিক হরমোন থেরাপি: ডায়াবেটিস ইনসিপিডাসে হরমোনের অভাবে মূত্রের পরিমাণ বাড়তে পারে, তাই চিকিৎসক হরমোনের থেরাপি দিয়ে শরীরে এর ঘাটতি পূরণ করতে পারেন।
- তরল গ্রহণের নিয়ন্ত্রণ: যদি বেশি তরল গ্রহণের কারণে বহুমূত্র হয়, তবে পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- ডায়ুরেটিকস বা অন্যান্য ওষুধের পর্যালোচনা: যদি বহুমূত্র কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ওই ওষুধের ডোজ পরিবর্তন বা পরিবর্তন করা উচিত।
- কিডনি সমস্যা চিকিৎসা: যদি কিডনির সমস্যা থাকে, তবে কিডনির চিকিৎসা করতে হবে। অতিরিক্ত পানি বা লবণ শরীরে জমতে পারে, তাই কিডনি সমস্যার চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
- হাইপারক্যালসেমিয়া কমানোর চিকিৎসা: অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের কারণে যদি বহুমূত্র হয়, তবে ক্যালসিয়াম গ্রহণ কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বহুমূত্র একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি ডায়াবেটিস বা কিডনি সমস্যা ইত্যাদির কারণে হয়। তাই, যদি কেউ দীর্ঘ সময় ধরে বহুমূত্রের সমস্যা অনুভব করে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
Top of Form
Bottom of Form