ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ (Pulmonary Heart Disease or Cor Pulmonale) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে ফুসফুসের সমস্যার কারণে হৃদপিণ্ডে চাপ বাড়ে এবং এর ফলে হৃদরোগের লক্ষণ তৈরি হয়। এটি সাধারণত ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে ঘটে, যা হৃদপিণ্ডের ডান দিকের অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফুসফুসের সমস্যা হলে হৃদপিণ্ডের কাজেও ব্যাঘাত ঘটে, কারণ এটি শরীরের অন্যান্য অংশে রক্ত সঞ্চালন করতে সহায়তা করে।
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের কারণ:
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ হওয়ার প্রধান কারণ হলো দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগগুলি, যেগুলি ফুসফুসের রক্তনালী বা শ্বাসনালীতে বাধা সৃষ্টি করে। এর কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD):
দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের ফুসফুসের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যায়, যার ফলে হৃদপিণ্ডের ডান দিক চাপের মধ্যে থাকে এবং এটি ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। - ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ (Pulmonary Hypertension):
ফুসফুসের রক্তনালীতে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হলে, হৃদপিণ্ডের ডান অংশে চাপ বাড়ে, যার ফলে এটি ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। - অ্যাজমা (Asthma):
দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাজমা হলে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে যায়, যার ফলে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ পড়ে। - ফুসফুসের অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগ:
যেমন ফুসফুসের ইনফেকশন, ফুসফুসের প্রদাহ (পনিউমোনিয়া) বা যক্ষা (টিউবারকুলোসিস) ইত্যাদি ফুসফুসের রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং এর ফলে হৃদরোগ সৃষ্টি হতে পারে। - মৌলিক শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা:
দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা যেমন ব্রঙ্কাইটিস, এমফিজেমা, বা কোনো ফুসফুসের টিউমার বা আঘাতও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। - থ্রম্বোএম্বোলিজম (Pulmonary Embolism):
ফুসফুসে রক্তের ক্লট চলে গেলে তা ফুসফুসে অবরোধ সৃষ্টি করে এবং হৃদপিণ্ডের ডান অংশে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের লক্ষণ:
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের লক্ষণগুলি সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং অন্যান্য হৃদরোগের মতো এর কিছু লক্ষণও থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- শ্বাসকষ্ট (Dyspnea):
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগে শ্বাস নেওয়ার সময় কষ্ট হতে পারে, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা রাতের বেলা। - বুকের ব্যথা:
বুকের মধ্যে চাপ বা ব্যথা অনুভব হতে পারে, যা হৃদরোগের একটি সাধারণ লক্ষণ। - অবসাদ বা ক্লান্তি:
শরীরের শক্তির অভাব, ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভূত হতে পারে, কারণ হৃদপিণ্ড তার কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। - পা বা গায়ে ফোলাভাব (Edema):
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের কারণে শরীরে তরল জমে যেতে পারে, বিশেষ করে পায়ে বা গোড়ালিতে ফোলাভাব হতে পারে। - হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া বা অনিয়মিত হওয়া (Palpitations):
হৃদপিণ্ডের স্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে গেলে এটি দ্রুত বা অনিয়মিত হতে পারে। - অ্যাঙ্গিনা (Angina):
বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা, যা অক্সিজেনের অভাবে হৃদযন্ত্রে চাপ পড়লে ঘটে। - ঘুমের সমস্যা:
শ্বাসকষ্টের কারণে রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হতে পারে। এটি কখনও কখনও এমন অবস্থায় পৌঁছাতে পারে যে রোগীকে শুয়ে না থেকে বসে থাকতে হয়।
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের প্রতিকার:
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের চিকিৎসা মূলত রোগটির কারণ এবং গুরুতরতার উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট প্রতিকার বা চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:
- ফুসফুসের রোগের চিকিৎসা:
ফুসফুসের রোগের সঠিক চিকিৎসা করা হলে ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের উপসর্গ অনেকটাই কমিয়ে আনা যেতে পারে। যেমন:- COPD বা অ্যাজমার জন্য ইনহেলার বা ব্রঙ্কোডাইলেটর।
- ফুসফুসে সংক্রমণ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা।
- শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপি।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ:
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগের জন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য চিকিৎসক উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। - অক্সিজেন থেরাপি:
যদি ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাব ঘটে, তবে অক্সিজেন থেরাপি প্রদান করা হতে পারে যাতে শরীরের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। - হৃদরোগের চিকিৎসা:
যদি হৃদপিণ্ডের কোনো সমস্যা থাকে, যেমন হার্ট ফেইলিওর বা অন্যান্য হৃদরোগ, তবে সেগুলির চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। এটি অন্তর্ভুক্ত করে:- বেটা-ব্লকারস, ACE ইনহিবিটরস, বা অন্যান্য হৃদরোগের ওষুধ।
- প্রয়োজনে হৃদযন্ত্রের সার্জারি বা স্টেন্ট স্থাপন।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ:
ধূমপান এবং মদ্যপান হৃদরোগ এবং ফুসফুসের সমস্যা বৃদ্ধি করে। তাই এগুলি পরিহার করা উচিত। - স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম ফুসফুস এবং হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। - ওজন নিয়ন্ত্রণ:
অতিরিক্ত ওজন হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
সারাংশ:
ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ একটি গুরুতর অবস্থা, যা ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে হৃদপিণ্ডের ডান দিকের চাপ বাড়ানোর ফলস্বরূপ ঘটে। এটি শ্বাসকষ্ট, বুকের ব্যথা, ক্লান্তি, পায়ে ফোলাভাব, এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করতে পারে। এর চিকিৎসা রোগের কারণ অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং ফুসফুস এবং হৃদরোগের যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ফুসফুসের পীড়াজনিত হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।