প্লেগ (Plague) একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা ইউারসিনিয়া পেস্টিস (Yersinia pestis) ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এটি সাধারণত পশু বা ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায় এবং মানুষের মধ্যে মাছির মাধ্যমে বা ইঁদুরের কামড়ে সংক্রমণ হতে পারে। প্লেগের ইতিহাস খুবই ভীতিকর, বিশেষত প্রাচীন কালে, যখন এর কারণে বিশাল জনগণের মৃত্যু হয়েছিল (যেমন “ব্ল্যাক ডেথ”)।
প্লেগের কারণ:
প্লেগের প্রধান কারণ হলো Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়া, যা ফ্লাই, ইঁদুর এবং অন্যান্য প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের বিভিন্ন ধরনের হয়:
- বুবোনিক প্লেগ (Bubonic plague): এটি প্লেগের সবচেয়ে সাধারণ এবং পুরনো ধরনের। এতে শরীরের লিম্ফ নোডগুলি আক্রান্ত হয়ে ফুলে উঠে এবং একে “বুবো” বলা হয়।
- সেপটিকেমিক প্লেগ (Septicemic plague): এটি প্লেগের আরো মারাত্মক ধরন, যেখানে ব্যাকটেরিয়া রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি ঘটাতে পারে।
- পনিউমোনিক প্লেগ (Pneumonic plague): এটি প্লেগের অত্যন্ত মারাত্মক ধরন, যেখানে ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়।
প্লেগের লক্ষণ:
প্লেগের লক্ষণ রোগের ধরন ও তার জটিলতার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ নিম্নরূপ:
১. বুবোনিক প্লেগের লক্ষণ:
- বুবো (Bubo): শরীরের লিম্ফ নোডে ফোলা এবং ব্যথা হওয়া, বিশেষ করে গলা, কাঁধ, বগল এবং শ্বাসযন্ত্রের কাছাকাছি।
- জ্বর: হঠাৎ করে উচ্চ জ্বর উঠতে পারে।
- দরদ: শরীরের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূতি।
- ঠান্ডা লাগা (Chills): কাঁপুনি এবং ঠান্ডা অনুভূতি হতে পারে।
- শক্তি হ্রাস: এক ধরনের অবসাদ বা অক্ষমতা।
- বমি বা ডায়রিয়া: খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটি হতে পারে।
২. সেপটিকেমিক প্লেগের লক্ষণ:
- রক্তে সংক্রমণ: যদি ব্যাকটেরিয়া রক্তে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি মারাত্মক রক্তের বিষ (Sepsis) সৃষ্টি করতে পারে।
- অঙ্গের অকেজো হওয়া: যেকোনো অঙ্গ যেমন যকৃত, কিডনি বা ফুসফুসের অকেজো হওয়া।
- বিশাল রক্তপাত: শরীরে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা হওয়া এবং ত্বকে লাল বা কালো দাগ দেখা যেতে পারে (নেক্রোসিস)।
৩. পনিউমোনিক প্লেগের লক্ষণ:
- শ্বাসকষ্ট: কাশির সাথে রক্ত দেখা যেতে পারে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
- উচ্চ তাপমাত্রা (ফিভার): উচ্চ তাপমাত্রা বা জ্বর।
- ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস: কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং সাঁইট-কোফি পুঁজ সহ।
- বক্ষব্যথা: চেস্ট পেইন এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা।
- দ্রুত অবস্থা খারাপ হওয়া: পনিউমোনিক প্লেগের ক্ষেত্রে দ্রুত মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
প্লেগের প্রতিকার:
প্লেগে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন, কারণ এটি দ্রুত জীবনহানির কারণ হতে পারে। প্লেগের প্রতিকার বা চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচে দেওয়া হল:
১. চিকিৎসা (Treatment):
- অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics): প্লেগের চিকিৎসা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা করা হয়, এবং যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, তত দ্রুত রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলি হলো:
- স্ট্রেপ্টোমাইসিন (Streptomycin)
- ডক্সিসাইক্লিন (Doxycycline)
- চ্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol)
চিকিৎসকের পরামর্শে এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলি নির্ধারিত হয়, যা ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- রক্তচাপ এবং তরল প্রয়োগ (Fluids and blood pressure management): প্লেগের সেপটিক বা পনিউমোনিক ধরনের ক্ষেত্রে রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা রক্তের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য তরল দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
- অক্সিজেন থেরাপি (Oxygen therapy): পনিউমোনিক প্লেগে আক্রান্ত হলে, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দূর করার জন্য অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।
২. প্রতিরোধ (Prevention):
- প্লেগ ভ্যাকসিন (Plague Vaccine): প্লেগের জন্য বর্তমানে কিছু দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে যেখানে প্লেগের প্রাদুর্ভাব বেশি। তবে, এই ভ্যাকসিন সব জায়গায় উপলব্ধ নয়।
- ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ: প্লেগ সাধারণত ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই ইঁদুর বা অন্যান্য রোগ-বাহিত প্রাণী নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- পশু–পাখির সুরক্ষা: ঘর বা অন্যান্য জায়গায় পোষা প্রাণীদের যত্ন নিতে হবে, যাতে তারা ইঁদুর বা অন্য রোগী প্রাণীর সংস্পর্শে না আসে।
- প্রাথমিক চিকিত্সা ও ক্ষত পরিচর্যা: যদি কোনো ব্যক্তি ইঁদুরের কামড় বা ক্ষত পায়, তবে তা দ্রুত পরিষ্কার করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এক্ষেত্রে টেটানাস ভ্যাকসিন বা অন্য যেকোনো প্রযোজ্য ভ্যাকসিন নিতে হবে।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: সাধারণ জীবাণু দূরীকরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, এবং পোকামাকড় থেকে দূরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সংক্রমণ প্রতিরোধ:
- মাছি বা মশা থেকে সতর্ক থাকা: রোগীর সংস্পর্শে সরাসরি আসা থেকে বিরত থাকুন, বিশেষত যদি তারা পনিউমোনিক প্লেগে আক্রান্ত হন।
- ব্যক্তিগত সুরক্ষা: পিপিই (PPE) বা স্বাস্থ্যকর সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করা উচিত যখন সংক্রমিত ব্যক্তি বা ইঁদুরের সংস্পর্শে আসতে হয়।
সারাংশ:
প্লেগ (Plague) একটি অত্যন্ত মারাত্মক এবং সংক্রামক ব্যাকটেরিয়াল রোগ, যা Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এটি মানুষের শরীরে ইঁদুরের কামড়, মাছি বা শ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায় এবং তার লক্ষণগুলি মারাত্মক হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি সুস্থ হওয়ার সুযোগ বাড়ে, তবে অপ্রতিকূল পরিস্থিতিতে এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন এবং প্রতিরোধের জন্য ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ ও ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রয়োজন।