প্লুরিসি (Pleurisy) বা প্লেউরাইটিস একটি অবস্থা, যেখানে ফুসফুসের বাইরের আবরণ (প্লুরা) বা শ্বাসযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ পর্দা (প্লুরা মেমব্রেন) প্রদাহিত হয়। এই পর্দাটি ফুসফুস এবং বুকের মাঝের অংশকে আবৃত করে, এবং যখন এটি প্রদাহিত হয়, তখন শ্বাস নেওয়ার সময় ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
প্লুরিসির কারণ:
প্লুরিসির বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে সাধারণত সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ থাকে। প্রধান কিছু কারণ হলো:
- ফুসফুসের সংক্রমণ:
- পনিউমোনিয়া (Pneumonia): ফুসফুসের প্রদাহ সংক্রমণ হলে প্লুরিসি হতে পারে।
- টিউবারকুলোসিস (TB): যক্ষ্মা একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা ফুসফুসের প্লুরা প্রদাহিত করতে পারে।
- ভাইরাল সংক্রমণ:
কিছু ভাইরাস যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস, বা প্রতিষেধক ভাইরাস (Parainfluenza virus) প্লুরিসি তৈরি করতে পারে। - ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ:
কখনও কখনও ব্যাকটেরিয়াও প্লুরিসি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন স্ট্রেপটোকক্কাস বা স্ট্যাফাইলোকক্কাস। - গোলব্লাডার বা পেটের রোগ:
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল সমস্যাগুলিও প্লুরার প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যদি পেটের কোনো অংশ ফুসফুসের আশেপাশে চলে আসে। - আর্থ্রাইটিস বা অটোইমিউন রোগ:
লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid arthritis) প্লুরার প্রদাহ তৈরি করতে পারে, কারণ এটি শরীরের নিজস্ব টিস্যুগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে পারে। - আঘাত বা ইনফেকশন:
প্লুরার ওপর আঘাত বা কোনও অপারেশনও প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। - নিউমোটোর্যাক্স:
ফুসফুসের মধ্যে বাতাস প্রবাহিত হয়ে প্লুরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্লুরিসি হতে পারে। - ক্যান্সার:
ফুসফুস বা পাঁজরের ক্যান্সারও প্লুরার প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
প্লুরিসির লক্ষণ:
প্লুরিসি আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস নেবার সময় বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ অনুভব করতে পারে। এর মধ্যে প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- গলা বা বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ ব্যথা:
শ্বাস নেয়ার সময় বা কাশি দিলে বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথা সাধারণত এক পাশের বুক বা গলায় অনুভূত হয় এবং গভীর শ্বাস নিলে এটি আরও তীব্র হয়। - শ্বাসকষ্ট:
শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে এবং কখনও কখনও শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে। - কাশি:
কিছু রোগী কাশি অনুভব করতে পারেন, যা প্লুরিসির সাথে যুক্ত থাকে। - জ্বর এবং ঠাণ্ডা লাগা:
প্লুরিসি সাধারণত কোনো সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, তাই রোগী জ্বর এবং ঠাণ্ডা অনুভব করতে পারে। - চোখে বা শরীরে ফোলাভাব:
শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন পা বা হাতেও ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। - শরীরের দুর্বলতা বা ক্লান্তি:
রোগীর শক্তির অভাব বা ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
প্লুরিসির প্রতিকার:
প্লুরিসির চিকিৎসা মূলত এর কারণের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু সাধারণত কিছু মূল চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে:
- অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা:
যদি প্লুরিসি ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, তবে চিকিৎসক রোগের ধরন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল মেডিকেশন প্রদান করতে পারেন। - এন্টি–ইনফ্লেমেটরি বা পেইন রিলিভার ওষুধ:
প্লুরিসির কারণে যেহেতু প্রদাহ হয়, তাই এন্টি-ইনফ্লেমেটরি (NSAIDs) বা পেইন রিলিভার যেমন ইবুপ্রোফেন বা পারাসিটামল চিকিৎসক দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। - স্টেরয়েড চিকিৎসা:
কিছু ক্ষেত্রে, যখন প্রদাহ বেশি থাকে, তখন স্টেরয়েড (যেমন প্রেডনিসোলোন) চিকিৎসা দেওয়া হতে পারে। - অক্সিজেন থেরাপি:
যদি শ্বাসকষ্ট অত্যন্ত গুরুতর হয়, তবে অক্সিজেন থেরাপি দেওয়া হতে পারে, যাতে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়। - সুস্থ জীবনযাপন:
প্লুরিসি বা ফুসফুসের কোনো সমস্যা থাকলে সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ধূমপান বা মদ্যপান থেকে বিরত থাকা উচিত। এগুলি শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক। - ফিজিওথেরাপি:
কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে রোগীকে শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য সহায়তা করা হয়। - পর্যাপ্ত বিশ্রাম:
শারীরিক বিশ্রাম রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি প্লুরিসি কোনো সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে।
সারাংশ:
প্লুরিসি একটি প্রদাহজনিত রোগ, যা ফুসফুসের বাইরের আবরণ বা প্লুরায় হয়। এটি সাধারণত সংক্রমণ, আঘাত বা অটোইমিউন রোগের কারণে হতে পারে। এর লক্ষণগুলির মধ্যে তীব্র বুকের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং কাশি রয়েছে। চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, এন্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ, এবং অক্সিজেন থেরাপি ব্যবহৃত হয়। সঠিক চিকিৎসা এবং বিশ্রাম সহ প্লুরিসি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
Top of Form
Bottom of Form