প্রসাবে জ্বালাপোড়া (Dysuria) হলো মুত্র ত্যাগের সময় ব্যথা, জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি অনুভব করা। এটি এক ধরনের অস্বাভাবিক অনুভূতি যা মুত্রনালী বা মুত্রথলিতে প্রদাহ বা সংক্রমণ থাকলে ঘটতে পারে। সাধারণত, প্রসাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া একটি সমস্যা যা উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এটি সঠিক চিকিৎসা না করলে আরও গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়ার কারণ:
- ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI): ইউটিআই সবচেয়ে সাধারণ কারণ, যেখানে ব্যাকটেরিয়া মুত্রপথে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এটি মুত্রথলি, মূত্রনালী বা কিডনির সংক্রমণ হতে পারে, যার ফলে প্রসাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা হতে পারে।
- মূত্রথলির প্রদাহ (Cystitis): মূত্রথলিতে প্রদাহ হলে প্রসাবের সময় জ্বালাপোড়া হতে পারে। এটি সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য অণুজীবের কারণে হয়ে থাকে।
- মূত্রনালী বা মূত্রপথের প্রদাহ (Urethritis): মূত্রনালিতে প্রদাহ ঘটলে প্রসাবে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হতে পারে। এটি সাধারণত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে (যেমন, গনোরিয়া বা ক্ল্যামিডিয়া)।
- স্টোন (পাথর): মূত্রপথে বা মূত্রথলিতে পাথর থাকলে, তা প্রসাবের সময় অস্বস্তি, ব্যথা বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। পাথর মূত্রনালী বা মূত্রথলির দেওয়ালে ঘষতে ঘষতে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
- ভাইরাল সংক্রমণ: হার্পিস সিম্পলেক্স ভাইরাস বা অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণও মূত্রনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা প্রসাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যালার্জি বা রিঅ্যাকশন: কিছু মলম, সাবান, ডিটারজেন্ট বা প্রসাধনী থেকে অ্যালার্জি বা রিঅ্যাকশন হতে পারে, যা মূত্রনালীতে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
- হরমোনাল পরিবর্তন: মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা, পিরিয়ড বা মেনোপজের সময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মূত্রনালির সংবেদনশীলতা বেড়ে যেতে পারে, যা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
- ক্যাথেটার ব্যবহার: মূত্রনালীতে ক্যাথেটার ব্যবহার করলে সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে পারে।
- যৌন রোগ (STDs): গনোরিয়া, ক্ল্যামিডিয়া, বা ট্রাইকোমোনাসসহ যৌনরোগও মূত্রনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা প্রসাবে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়ার লক্ষণ:
- প্রসাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া: এটি সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ, যেখানে প্রসাবের সময় মুত্রনালী বা মূত্রথলিতে জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়।
- প্রসাবের পর অস্বস্তি: মুত্র ত্যাগ করার পরেও কিছু সময় অস্বস্তি বা চাপ অনুভূত হতে পারে।
- প্রসাবের অস্বাভাবিক গন্ধ: ইউটিআই বা সংক্রমণের কারণে মুত্রের গন্ধ পরিবর্তিত হয়ে তীব্র বা অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।
- রক্তমিশ্রিত প্রসাব: যদি প্রসাবে রক্ত দেখা যায়, তবে এটি ইউটিআই বা মূত্রথলির পাথরের লক্ষণ হতে পারে।
- প্রসাবের পরিমাণ কমে যাওয়া: প্রসাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে এবং বেশিরভাগ সময় অল্প পরিমাণে প্রসাব হতে পারে।
- পেটের নিচে ব্যথা বা চাপ: মূত্রথলির প্রদাহের কারণে পেটের নিচের অংশে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- প্রসাবের ক্ষেত্রে তীব্র তৃষ্ণা বা অতিরিক্ত পিপাসা: ইউটিআই বা ডায়াবেটিসের কারণে অতিরিক্ত পিপাসা ও প্রসাবের অনুভূতি বাড়তে পারে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়ার প্রতিকার:
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা: ইউটিআই বা মূত্রথলির সংক্রমণের ক্ষেত্রে, চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া দূর করার জন্য সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া উচিত।
- বেশি পরিমাণে পানি পান করা: প্রচুর পরিমাণে পানি পান করলে ব্যাকটেরিয়া শরীর থেকে বের হয়ে যায় এবং প্রসাবে জ্বালাপোড়া কমে।
- হালকা ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: অতিরিক্ত মশলা, ক্যাফেইন, অ্যালকোহল ও সাইট্রাস জাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত, কারণ এগুলি মূত্রনালীতে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- বিশ্রাম নেওয়া: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- গরম সেঁক দেওয়া: পেটের নিচে গরম সেঁক দিলে ব্যথা ও অস্বস্তি কমানো যেতে পারে। তবে, সেঁক যেন খুব গরম না হয়, যাতে ত্বকে ক্ষতি না হয়।
- পুনরায় স্নান ও মূত্রপথের পরিচর্যা: মূত্রপথের সঠিক পরিচর্যা ও স্নান করা জরুরি। মুত্রপথ পরিষ্কার রাখা, বিশেষত মহিলাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা: যদি ভাইরাল সংক্রমণ (যেমন হার্পিস) হয়, তাহলে চিকিৎসক অ্যান্টিভাইরাল মেডিসিন প্রদান করতে পারেন।
- যৌন সম্পর্কের পর স্নান করা: যৌন সম্পর্কের পর মূত্রপথ পরিষ্কার রাখা এবং স্নান করা ভালো, যাতে সংক্রমণ বা প্রদাহ প্রতিরোধ করা যায়।
- পাশাপাশি অন্য রোগের চিকিৎসা: ডায়াবেটিস বা অন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকলে, সেগুলোর সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে, কারণ এগুলো প্রসাবে জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ:
প্রসাবে জ্বালাপোড়া অনুভূত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, বিশেষত যদি লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয়, বা প্রসাবে রক্ত, প্রবাহে পরিবর্তন বা জ্বর থাকে। প্রাথমিক চিকিৎসা করলে সমস্যাটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।