প্রসবান্তে জ্বর (Postpartum Fever) হলো সন্তান জন্ম দেওয়ার পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে শরীরের তাপমাত্রার বৃদ্ধি। এটি একটি সাধারণ সমস্যা, তবে কখনো কখনো এটি গুরুতর হতে পারে, এবং এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রসবের পর যেকোনো জ্বরের কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন, কারণ এটি কোনো সংক্রমণ বা অন্য কোন শারীরিক জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।
প্রসবান্তে জ্বরের কারণ:
- গর্ভাশয়ের সংক্রমণ (Endometritis):
- এটি প্রসবের পর সবচেয়ে সাধারণ সংক্রমণ। গর্ভাশয়ের শ্লেষ্মা বা প্লেসেন্টা যদি পুরোপুরি পরিষ্কার না হয়, তাহলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে, যা গর্ভাশয়ের সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখা দেয়।
- মূত্রথলির সংক্রমণ (Urinary Tract Infection, UTI):
- প্রসবের পর মূত্রথলির সংক্রমণও সাধারণ। সিজারিয়ান অপারেশন বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসবকালে ক্যাথেটার ব্যবহার করলে এটি আরও বেশি হতে পারে। মূত্রথলির সংক্রমণ শরীরে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
- স্তনের সংক্রমণ (Mastitis):
- স্তনে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে স্তনে ফোলা, ব্যথা এবং জ্বর হতে পারে। এটি সাধারণত দুধের উৎপাদন শুরু হওয়ার পর ঘটে, বিশেষত যদি শিশুটি ঠিকভাবে স্তনপান না করে।
- গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল সংক্রমণ:
- প্রসবের পর কিছু ক্ষেত্রে পেটের বা অন্ত্রের সমস্যা হতে পারে, যা শরীরে তাপমাত্রা বাড়াতে পারে। ডায়রিয়া, বমি বা পেট ব্যথা এর সাথে হতে পারে।
- রক্তের সংক্রমণ (Sepsis):
- যদি গর্ভধারণের সময় বা প্রসবের সময় কোনো ধরনের সংক্রমণ হয়ে থাকে, তবে তা রক্তে ছড়িয়ে গিয়ে সেপসিস সৃষ্টি করতে পারে, যা মারাত্মক হতে পারে। এটি জ্বরসহ অন্যান্য উপসর্গ সৃষ্টি করে।
- প্লীহা বা অন্যান্য অঙ্গের ইনফেকশন:
- প্রসবের সময় বা পরে অন্যান্য অঙ্গেও সংক্রমণ হতে পারে, যেমন প্লীহা, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
- যান্ত্রিক সমস্যা:
- যদি প্রসবের সময় অত্যধিক রক্তপাত ঘটে বা যদি কোনো অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে, তবে শরীরের কোনো অংশে ক্ষত বা সংক্রমণ হয়ে জ্বর সৃষ্টি হতে পারে।
- হরমোনাল পরিবর্তন:
- প্রসবের পর শরীরে হরমোনের পরিবর্তনও কিছু সময়ের জন্য তাপমাত্রা বাড়াতে পারে। তবে এই ধরনের জ্বর সাধারণত সাময়িক হয় এবং এক-দুই দিনের মধ্যে চলে যায়।
প্রসবান্তে জ্বরের লক্ষণ:
- উচ্চ তাপমাত্রা (ফিভার):
- প্রসব পরবর্তী শরীরের তাপমাত্রা ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি হয়ে থাকে, যা জ্বরের প্রধান লক্ষণ।
- দুর্বলতা বা ক্লান্তি:
- প্রসবের পর যেকোনো সংক্রমণের কারণে শরীরে দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
- শরীরের ব্যথা:
- জ্বরের সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে মাংসপেশী বা হাড়ে।
- ঘাম বা ঠান্ডা অনুভব করা:
- প্রসবান্তে জ্বরের কারণে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম বা ঠান্ডা অনুভূত হতে পারে।
- শিশু বা স্তনপান সমস্যা:
- স্তনে সংক্রমণ বা স্তনশূলের কারণে জ্বর হলে স্তন থেকে দুধের প্রবাহে সমস্যা হতে পারে এবং শিশুকে স্তন খাওয়াতে অসুবিধা হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নেওয়া:
- যদি সেপসিস বা রক্তের সংক্রমণ ঘটে, তাহলে শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসের গতি বাড়তে পারে।
- অতিরিক্ত কাঁপুনি বা শীতল অনুভূতি:
- এক্ষেত্রে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে এবং কাঁপুনি হতে পারে, যা সাধারণত তীব্র সংক্রমণের লক্ষণ।
প্রসবান্তে জ্বরের প্রতিকার:
- চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ:
- প্রসবের পর যদি জ্বর দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক রক্ত বা মূত্র পরীক্ষা করতে পারেন, এবং সংক্রমণের ধরণ চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা দেবেন।
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা:
- যদি গর্ভাশয়ের সংক্রমণ বা অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ হয়, তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দেবে। যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
- পানির পরিমাণ বৃদ্ধি:
- জ্বরের সময় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচুর পানি পান করা প্রয়োজন। এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করবে।
- বিশ্রাম নেওয়া:
- প্রসবের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং শারীরিক চাপ কমানো গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরকে সংক্রমণ মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।
- স্তনপান নিশ্চিত করা:
- যদি স্তনে সংক্রমণ হয়ে থাকে, তবে চিকিৎসক পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেবেন। তবে স্তনপান চালিয়ে যাওয়াও দুধ উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করবে এবং এটি সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
- প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খাওয়া:
- শরীরকে শক্তিশালী রাখতে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। ভিটামিন সি, প্রোটিন এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
- গরম পানি দিয়ে স্নান বা সেঁক:
- গর্ভাশয়ের বা স্তনের কোনো ক্ষতি বা সংক্রমণ থাকলে গরম পানি দিয়ে স্নান বা সেঁক দিতে সহায়ক হতে পারে।
- হাসপাতালে ভর্তি:
- যদি জ্বর বেশি হয়, বা কোনো জটিলতা দেখা দেয়, তবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
উপসংহার:
প্রসবান্তে জ্বর সাধারণত সংক্রমণের কারণে হতে পারে, তবে কখনো কখনো এটি শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদি প্রসবের পর জ্বর হয়, তবে এটি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সময়মতো চিকিৎসা এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।