পুরতন ক্ষত পচনশীল ক্ষত (Chronic or Decaying Wound) এমন একটি ক্ষত বা আঘাত যা দীর্ঘ সময় ধরে ভালো হতে না পেরে পচনশীল বা সংক্রমিত হয়ে যায়। এটি সাধারণত সেই ধরনের ক্ষত, যেগুলি যথাযথ যত্ন বা চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ে এবং পচন বা গন্ধ বের হতে থাকে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, যা দ্রুত চিকিৎসা না হলে জীবনশঙ্কা হতে পারে।
কারণ:
পুরতন ক্ষত পচনশীল ক্ষতের কিছু প্রধান কারণ:
- অসুস্থতা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া:
- ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইচআইভি, বা অন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুখের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ক্ষত দ্রুত সংক্রমিত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
- খারাপ রক্তসঞ্চালন:
- পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ (PAD) বা রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা (যেমন, পায়ের শিরার সমস্যায়) থাকলে ক্ষত সেরে উঠতে সময় নেয় এবং পচন হতে পারে।
- অপর্যাপ্ত ক্ষত পরিচর্যা:
- পুরনো বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত যে ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা চিকিৎসার মাধ্যমে যত্ন নিন না, তা সংক্রমিত হতে পারে এবং পচনশীল হয়ে যায়। ক্ষতটি সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা, ইনফেকশন না প্রতিরোধ করা ইত্যাদি কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
- বয়স:
- বয়স্ক ব্যক্তিদের ত্বক কম ইলাস্টিক এবং শুষ্ক হয়, ফলে তাদের শরীরের ক্ষত সেরে উঠতে দেরি হয়। এছাড়া, বয়সের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যার কারণে ক্ষত সহজে সংক্রমিত হতে পারে।
- প্রতিবন্ধকতা বা শারীরিক সমস্যাগুলি:
- যারা স্থির হয়ে বসে বা শুয়ে থাকেন, তাদের মধ্যে যেমন শয্যাশায়ী রোগী, তাদের শরীরে এক জায়গায় চাপ পড়ে, যার ফলে পচনশীল ক্ষত হতে পারে (এটা সাধারণত প্রেশার আলসার বা বেড সোর নামে পরিচিত)।
- ভুল জীবনযাপন বা স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অভাব:
- সঠিক পুষ্টির অভাব, ধূমপান, মদ্যপান, এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যার কারণে ক্ষত দ্রুত ভালো হতে পারে না এবং পচনশীল হয়ে যায়।
লক্ষণ:
পুরতন বা পচনশীল ক্ষতের কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- পচা বা দুর্গন্ধ:
- ক্ষত থেকে তীব্র গন্ধ বের হওয়া, যা পচন বা সংক্রমণের চিহ্ন হতে পারে। পচনশীল ক্ষত সাধারণত খুব মন্দ গন্ধ সৃষ্টি করে।
- ফোলা বা লাল হওয়া:
- ক্ষতটি ফোলা বা লাল হয়ে যায়। এটি ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে, যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রমণ মোকাবিলা করতে কাজ করছে।
- পুঁজ বা তরল বের হওয়া:
- ক্ষত থেকে পুঁজ বের হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ, যা সংক্রমণ বা পচনের সাথেও সম্পর্কিত। পুঁজ কখনও কখনও সাদা, হলুদ বা সবুজ হতে পারে এবং এতে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণু থাকতে পারে।
- ব্যথা বা অস্বস্তি:
- পুরনো ক্ষত সাধারণত ব্যথা বা তীব্র অস্বস্তি সৃষ্টি করে, বিশেষত যদি এটি সংক্রমিত হয়ে থাকে।
- রক্তক্ষরণ:
- যদি ক্ষতটি গুরুতর হয়, তবে তা থেকে রক্ত বের হতে পারে। এটি সাধারাণত তখন ঘটে যখন ক্ষতটি বেশি গভীর হয় বা সংক্রমণের কারণে ক্ষত অংশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- জ্বর ও দুর্বলতা:
- সংক্রমিত ক্ষতের কারণে জ্বর এবং শরীরের অন্যান্য সিস্টেমে অস্বস্তি হতে পারে। জ্বর এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, যা শরীর সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
প্রতিকার:
পুরনো বা পচনশীল ক্ষতের চিকিৎসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে এবং এটি বিশেষ যত্ন ও সঠিক চিকিৎসা দাবি করে:
- ক্ষত পরিষ্কার ও ড্রেসিং:
- প্রথমত, ক্ষতটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষভাবে, ইনফেকশনের দিকে নজর দিতে হবে। ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করা উচিত। নিয়মিত ড্রেসিং ও ব্যান্ডেজ পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা:
- যদি ক্ষতটি সংক্রমিত হয়ে থাকে, তবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বা ক্রিম ব্যবহার করা উচিত। এটি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করবে।
- অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা:
- যদি ক্ষতটি ফাঙ্গাল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, তবে অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা পিল ব্যবহার করতে হবে।
- পুষ্টির সাপোর্ট:
- সঠিক পুষ্টি (বিশেষ করে প্রোটিন, ভিটামিন সি এবং জিঙ্ক) শরীরের নিরাময় প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সাহায্য করে। এটি কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে এবং ত্বক সেরে উঠতে সহায়ক।
- অপারেশন (চিকিৎসার জন্য শল্যচিকিৎসা):
- যদি ক্ষত গভীর হয় বা পচন অনেক বেশি হয়ে থাকে, তবে অপারেশন করতে হতে পারে। এটি সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারে, এবং ক্ষতটি পরিস্কার করা হতে পারে।
- প্রতিবন্ধকতা এবং চাপ কমানো:
- যারা দীর্ঘ সময় বসে বা শুয়ে থাকেন, তাদের চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত পজিশন পরিবর্তন করতে হবে। প্রেশার আলসার (pressure ulcer) প্রতিরোধ করতে বিশেষভাবে বসে বা শুয়ে থাকার সময় সঠিক প্যাড বা পেড ব্যবহার করা যেতে পারে।
- সাধারণ জীবনযাপন এবং হাইজিন:
- সঠিক জীবনযাপন, যেমন ধূমপান বা মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, শরীরের যথাযথ পরিচর্যা রাখা (বিশেষ করে ব্যক্তিগত হাইজিন) এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।
প্রতিরোধ:
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বজায় রাখতে সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
- ডায়াবেটিস বা অন্য অসুখের নিয়মিত চিকিৎসা:
- যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকে, যেমন ডায়াবেটিস, তবে সেগুলির সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, যাতে ক্ষত দ্রুত নিরাময় পায়।
- প্রাথমিক চিকিৎসা:
- ক্ষত তৈরি হলে সঠিক সময়ের মধ্যে তা পরিষ্কার এবং চিকিৎসা করা উচিত, যাতে তা সংক্রমিত না হয়ে পচনশীল না হয়ে যায়।
পুরনো বা পচনশীল ক্ষতের চিকিৎসা যদি সঠিকভাবে না করা হয়, তবে এটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, যে কোনো ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হলে বা পচনশীল হলে তা দ্রুত চিকিৎসককে দেখানো উচিত।