নাড়ীভুঁড়ির পথ আটকে যাওয়া (Intestinal Obstruction) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে অন্ত্রের (যথা: ছোট অন্ত্র বা বড় অন্ত্র) কোন অংশে খাবার বা গ্যাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এটি অন্ত্রের এক প্রকার ব্লকেজ, যা সাধারণত তীব্র ব্যথা, বমি, অস্বস্তি এবং পেটের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করে। নাড়ীভুঁড়ির পথ আটকে যাওয়া দ্রুত চিকিৎসা প্রক্রিয়া দাবি করে এবং এটি অনেক ধরনের শারীরিক জটিলতার দিকে পরিচালিত করতে পারে।
কারণ:
নাড়ীভুঁড়ির পথ আটকে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, কিছু প্রধান কারণ হলো:
- অন্ত্রের ব্লকেজ (Physical Obstruction):
- কলোন (Colon) বা অন্ত্রের কোনও অংশে বন্ধ হয়ে যাওয়া: অন্ত্রের মধ্যে মলের জমা বা কিছু গ্যাস আটকে গেলে এটি ব্লকেজ সৃষ্টি করতে পারে।
- এডিসন (Adhesions): অপারেশন বা শল্য চিকিৎসার পর যে সেল্ফ (অ্যাডহিশন) তৈরি হয়, তা অন্ত্রকে আটকে ফেলতে পারে।
- ইনগ্যাস (Inguinal Hernia): অন্ত্রের কোন অংশ হালকা বা শক্তির মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে এসে আটকে যেতে পারে।
- ইনফ্লেমেটরি বোল ডিজিজ (Inflammatory Bowel Disease):
- ক্রোনের রোগ (Crohn’s Disease): এটি অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ, যা অন্ত্রের ভিতর ব্লকেজ সৃষ্টি করতে পারে।
- কলাইটিস (Colitis): অন্ত্রের প্রদাহের কারণে ফোলাভাব এবং ব্লকেজ হয়ে যেতে পারে।
- ক্যান্সার: অন্ত্রে ক্যান্সার থাকলে ব্লকেজ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত, বড় অন্ত্রে (Colon cancer) ব্লকেজ সাধারণত দেখা যায়।
- কোলিক (Colic):
শিশুদের ক্ষেত্রে অন্ত্রে ফাঁকা জায়গায় আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। - ব্লকেজ বা অভ্যন্তরীণ স্ফীতি (Intestinal volvulus): অন্ত্রের একটি অংশ ঘুরে গিয়ে নিজের আশপাশে আটকে যেতে পারে (volvulus), যা অবরুদ্ধতার সৃষ্টি করে।
- কিডনি বা পিত্তথলির পাথর:
কখনও কখনও কিডনি বা পিত্তথলির পাথর অন্ত্রের মধ্যে প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। - প্যারালিটিক ইলিয়াস (Paralytic ileus): যদি অন্ত্রের গতিশীলতা (peristalsis) থেমে যায়, তবে এটি অন্ত্রের পথে চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে।
- অন্টার্কাল স্ট্রিকচার বা ফাইব্রোসিস:
ফাইব্রোসিসের কারণে অন্ত্রের দেয়ালের মধ্যে সঙ্কুচিত হওয়া বা কঠিন হওয়া অন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
লক্ষণ:
নাড়ীভুঁড়ির পথ আটকে যাওয়ার লক্ষণগুলি প্রাথমিক অবস্থায় বেশ তীব্র হতে পারে এবং রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- পেটব্যথা বা মুচড়ে যাওয়া:
পেটের মধ্যে তীব্র ব্যথা বা মুচড়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে, বিশেষ করে যদি অন্ত্রের কোন অংশ আটকে যায়। - বমি:
অন্ত্রের পথে খাবার বা গ্যাস আটকে যাওয়ার কারণে বমি হতে পারে, যা কখনও কখনও গা dark ় বা পাতলা হতে পারে। - পেট ফুলে যাওয়া (বেলচিং):
অন্ত্রে গ্যাস জমে গিয়ে পেট ফুলে যায় এবং পেটের মধ্যে চাপ বা অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে। - মলত্যাগের সমস্যা:
অন্ত্রের ব্লকেজের কারণে রোগী পেট খালি করার সমস্যা অনুভব করতে পারে। এটি কখনও কখনও ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো লক্ষণও সৃষ্টি করতে পারে। - বাড়তি গ্যাস বা গলানোর সমস্যা:
অন্ত্রের গ্যাস বা আউটপুট আছড়ে পড়ার কারণে অতিরিক্ত গ্যাস সৃষ্টির ফলে রোগী কিছুটা অতিরিক্ত ফ্ল্যাটুলেন্স বা গ্যাসের সমস্যা অনুভব করতে পারে। - রক্তাক্ত মল:
কিছু ক্ষেত্রে অন্ত্রের ব্লকেজের কারণে মল রক্তাক্ত হতে পারে, বিশেষ করে ক্যান্সার বা প্রদাহের কারণে। - শরীরের দুর্বলতা:
অনেক সময় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যদি ব্লকেজের কারণে পুষ্টির শোষণ ঠিক মতো না হয়। - তীব্র তৃষ্ণা বা জ্বর:
যদি ব্লকেজের কারণে শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে, তবে জ্বর বা তীব্র তৃষ্ণা অনুভূত হতে পারে।
প্রতিকার:
নাড়ীভুঁড়ির পথ আটকে যাওয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে ব্লকেজের কারণ এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। নিচে কিছু সাধারণ প্রতিকার দেওয়া হলো:
- অপারেশন (Surgical Intervention):
- অনেক ক্ষেত্রে, যদি ব্লকেজ টিউমার, অভ্যন্তরীণ ক্ষতি বা পেরিলেটিক ইলিয়াসের কারণে হয়, তবে সার্জারি করতে হতে পারে। সার্জারির মাধ্যমে ব্লকেজ অপসারণ করা হয় বা বন্ধ হওয়া অংশ সরিয়ে দেওয়া হয়।
- ইনফ্লামেটরি বোল ডিজিজের চিকিৎসা:
- প্রদাহজনিত রোগ (যেমন ক্রোনের রোগ) থাকলে ঔষধ (কোর্টিকোস্টেরয়েড, ইমিউনো-সাপ্রেসিভ ড্রাগস) দেওয়া হতে পারে।
- অ্যান্টিবায়োটিক ও স্যালাইন (Antibiotics & Saline) দ্রব্য ব্যবহার:
ইনফেকশনের কারণে ব্লকেজ হলে, চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক বা স্যালাইন ইন্ট্রাভেনাস (IV) সলিউশন প্রয়োগ করতে পারেন। - ফ্লুইড রিস্টোরেশন:
জলশূন্যতা রোধে অথবা পুষ্টির অভাব পূরণের জন্য ফ্লুইড ইন্ট্রাভেনাস দিতে হতে পারে। - মল শোষণ বা এনিমা (Enema):
কিছু ক্ষেত্রে অন্ত্রে থেকে ব্লকেজ অপসারণের জন্য মল শোষণ বা এনিমা ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি বিশেষত কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে ব্লকেজ হলে কার্যকরী হতে পারে। - ডায়েট পরিবর্তন:
কিছু সময় সহজ হজমযোগ্য খাবার ও তরল খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়ানো যায়। - পেটের ম্যাসাজ বা থেরাপি:
কিছু ক্ষেত্রে পেটের মধ্যে নরম টিপ্পনি বা ম্যাসাজও ব্লকেজ সরাতে সাহায্য করতে পারে, তবে এটি শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিত। - প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
নিয়মিত পেট পরিষ্কার রাখা, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, প্রচুর পানি পান এবং ব্যায়াম করতে হবে যাতে অন্ত্রে ব্লকেজের ঝুঁকি কমে।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- যদি পেটের তীব্র ব্যথা থাকে।
- যদি পেট ফুলে যায় এবং ব্যথার সাথে বমি হয়।
- যদি মলত্যাগে সমস্যা হয় বা একাধিক দিন ধরে কোনো মলত্যাগ না হয়।
- যদি মল রক্তাক্ত হয় বা মলের সঙ্গে অসুস্থতার লক্ষণ থাকে।
এই ধরনের অবস্থায় জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন। অবহেলা করলে আরও গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।