জলবসন্ত (Chickenpox) একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ, যা ভ্যারিসেলা–জোস্টার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি খুবই সংক্রামক এবং সাধারণত শিশুরা এতে আক্রান্ত হয়, তবে বড়দের মধ্যেও হতে পারে। জলবসন্ত সাধারণত খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরো শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক ধরনের ত্বকের র্যাশ ও গা ঘোরানোর মতো উপসর্গের সৃষ্টি করে।
কারণ:
জলবসন্ত ভ্যারিসেলা–জোস্টার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা হেরপিসভাইরাস পরিবারের সদস্য। এই ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে বা আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসে, যেমন:
- শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে (কাশি, হাঁচি, বা কথা বলার সময়)
- আক্রান্ত ত্বকের স্পর্শের মাধ্যমে (র্যাশ বা জলবসন্তের দানাগুলি)
- আক্রান্ত ব্যক্তি দ্বারা ব্যবহৃত গামছা, টাওয়েল, বা অন্যান্য পোশাকের মাধ্যমে
লক্ষণ:
জলবসন্তের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- র্যাশ (Rash):
- প্রথমে ত্বকে লাল রঙের ছোট ছোট দানা (blisters) দেখা দেয়, যা পরে জলপূর্ণ ফুসকুড়ি (blisters) হয়ে ওঠে এবং পরে চুলকানি ও ফেটে গিয়ে দাগ হয়ে যায়।
- এই র্যাশ মুখ, মাথা, বুক, পিঠ, হাত, পা সহ শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- জ্বর:
- রোগী সাধারণত হালকা বা মাঝারি মাত্রার জ্বরে ভোগে, যা র্যাশ দেখা দেওয়ার আগেই শুরু হতে পারে।
- শরীরের অন্যান্য অস্বস্তি:
- শরীরের দুর্বলতা, ক্লান্তি, অস্বস্তি বা মাথাব্যথা হতে পারে।
- চুলকানি (Itching):
- র্যাশের জায়গায় তীব্র চুলকানি হতে পারে, যা রোগীকে অস্বস্তিতে ফেলে।
- খাবারে অরুচি:
- জলবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তির খাবারে অরুচি থাকতে পারে বা খেতে ইচ্ছা নাও হতে পারে।
- তীব্র ক্লান্তি বা শারীরিক দুর্বলতা:
- রোগী ঘুমাতে বা বিশ্রাম নিতে পারলেও, শরীর খুব দুর্বল থাকতে পারে এবং ক্লান্তি অনুভব হয়।
- গলা ব্যথা ও সর্দি:
- কিছু ক্ষেত্রে, জলবসন্তের সাথে গলা ব্যথা বা সর্দিও থাকতে পারে।
প্রতিকার:
জলবসন্তের নির্দিষ্ট কোন অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই, তবে রোগের উপসর্গ হ্রাস করার জন্য এবং রোগীকে আরাম দেওয়ার জন্য কিছু প্রাথমিক প্রতিকার নেয়া যেতে পারে:
- চুলকানি কমানোর জন্য ওষুধ:
- অ্যান্টিহিস্টামিন (যেমন: ডিপেনহাইড্রামাইন) ব্যবহার করা যেতে পারে, যা চুলকানি কমাতে সাহায্য করে। তবে এই ধরনের ওষুধ শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।
- প্যারাসিটামল:
- জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে আইবুপ্রোফেন বা অন্যান্য NSAIDs (Nonsteroidal Anti-Inflammatory Drugs) জলবসন্তের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ তা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- পানি দিয়ে গোসল ও ঠাণ্ডা স্নান:
- ঠাণ্ডা পানিতে স্নান বা ঠাণ্ডা জল ব্যবহার করে শরীর ঠাণ্ডা রাখা। বিশেষত ওটমিল বা বেকিং সোডা দিয়ে স্নান করলে চুলকানি ও অস্বস্তি অনেকটা কমে যায়।
- ভিটামিন সি:
- ভিটামিন সি শেয়ার করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। ফল ও শাকসবজি থেকে এই ভিটামিন পাওয়া যায়।
- প্রচুর পানি পান করা:
- শরীরের ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে প্রচুর পানি পান করা উচিত। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে।
- বিশ্রাম ও আরাম:
- জলবসন্তে আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগের দ্রুত উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হয়।
- চুলকানি ও র্যাশের জন্য মেন্টল বা ক্যামফর লোশন:
- কিছু মেন্টল বা ক্যামফর লোশন বা কালামাইন লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে, যা চুলকানি কমাতে সাহায্য করে।
- ভ্যাকসিন (Prevention):
- ভ্যারিসেলা টিকা (Varicella Vaccine) জলবসন্ত প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর। টিকাটি সাধারণত ১২ মাস বয়সের পর দেওয়া হয়, এবং দুটি ডোজ দেওয়া হয়—প্রথম ডোজ ১২-১৫ মাস বয়সে এবং দ্বিতীয় ডোজ ৪-৬ বছর বয়সে। টিকা দেওয়ার মাধ্যমে জলবসন্ত থেকে শতকরা ৯০% পর্যন্ত প্রতিরোধ পাওয়া যায়।
- বড়দের জন্য অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা:
- বড়দের ক্ষেত্রে বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ (যেমন: অ্যাসিক্লোভির) ব্যবহার করা যেতে পারে, যা রোগের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে হবে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:
- যদি র্যাশে তীব্র প্রদাহ বা সংক্রমণ দেখা দেয়।
- যদি জ্বর ১০০°F (৩৮.৮°C) বা তার বেশি থাকে এবং ৪৮ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়।
- যদি চুলকানি বা র্যাশ খুব মারাত্মক হয়ে ওঠে।
- যদি অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন শ্বাসকষ্ট, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পীড়াদায়ক পরিস্থিতি, বা বিভ্রান্তি।
- যদি রোগী গর্ভবতী হন বা অন্য কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে।
উপসংহার:
জলবসন্ত একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ, তবে এটি খুবই সংক্রামক এবং কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর হতে পারে। টিকা গ্রহণ এর সেরা প্রতিরোধ উপায় এবং দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে আরাম দেওয়া যায়। যদি আক্রান্ত ব্যক্তি শিশু না হন, বা যদি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।