জরায়ুতে টিউমার (Uterine Tumor) হল জরায়ুর মধ্যে বা তার আশপাশে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই ধরনের টিউমার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনাইন (benign) হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ম্যালিগন্যান্ট (malignant) বা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। জরায়ুর টিউমারগুলি সাধারণত ফাইব্রয়েড (Fibroids), এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) বা ইউটেরাইন ক্যান্সার (Uterine Cancer) হিসেবে দেখা যেতে পারে।
জরায়ুতে টিউমারের কারণ:
জরায়ুর টিউমারের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে কিছু কারণ বা ঝুঁকি ফ্যাক্টর রয়েছে যা জরায়ুর টিউমারের সৃষ্টি করতে পারে:
- হরমোনের পরিবর্তন:
- জরায়ুর টিউমারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন হরমোন। এস্ট্রোজেনের আধিক্য জরায়ুর টিউমারের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। বিশেষত ফাইব্রয়েড (fibroid) হল একটি সাধারণ জরায়ু টিউমার যা হরমোনের কারণে বাড়ে।
- বয়স:
- সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে জরায়ু টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এটি কম বয়সীদেরও হতে পারে।
- জেনেটিক বা বংশগত কারণ:
- যদি পরিবারের মধ্যে কেউ জরায়ু টিউমারের শিকার হন, তবে অন্যদেরও এই ধরনের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- ওজন বাড়ানো বা স্থূলতা:
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা (obesity) জরায়ুর টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ এটি হরমোনের অসমতা সৃষ্টি করতে পারে।
- গর্ভধারণ বা সন্তান না হওয়া:
- যেসব মহিলারা জীবনে কখনো গর্ভধারণ করেননি, তাদের জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি বেশি হতে পারে। গর্ভধারণের অভাব টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, তামাক বা অ্যালকোহল সেবন, অনিয়মিত জীবনযাপন জরায়ুর টিউমারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
জরায়ুতে টিউমারের লক্ষণ:
জরায়ু টিউমারের লক্ষণ তার আকার, ধরন এবং অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- অস্বাভাবিক রক্তপাত:
- সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হল অস্বাভাবিক রক্তপাত, যেমন মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত বা মাসিকের বাইরে রক্তপাত হওয়া। কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী রক্তপাতও দেখা দিতে পারে।
- পেটে ব্যথা বা চাপ অনুভূতি:
- জরায়ুতে টিউমার থাকলে পেটে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে, বিশেষত পেটের নিচের দিকে। এই ব্যথা সময়ের সঙ্গে বাড়তে পারে।
- গর্ভধারণে সমস্যা:
- জরায়ুর টিউমার গর্ভধারণের সময় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যদি টিউমারটি জরায়ুর ভেতরে থাকে। এটি গর্ভাবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন গর্ভপাত বা গর্ভধারণে সমস্যা।
- মূত্রনালি বা পায়ুপথে সমস্যা:
- যদি টিউমারটি বড় হয়ে মূত্রনালি বা পায়ুপথে চাপ দেয়, তবে মূত্রত্যাগ বা পায়খানা করার সময়ে সমস্যা হতে পারে, যেমন অসুবিধা বা অতিরিক্ত চাপ অনুভূতি।
- কখনও কখনও পেট ফুলে ওঠা:
- জরায়ুর টিউমার বড় হয়ে পেটের অংশে ফুলে যেতে পারে, যার ফলে পেট ফুলে থাকার অনুভূতি হতে পারে।
- শারীরিক দুর্বলতা বা ক্লান্তি:
- দীর্ঘ সময় ধরে রক্তপাত বা শরীরের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শরীরকে দুর্বল করতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং শারীরিক দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে।
জরায়ুতে টিউমারের প্রতিকার:
জরায়ুর টিউমারের চিকিৎসা তার ধরন, আকার এবং অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ চিকিৎসার পদ্ধতি:
- ওষুধ (Medications):
- হরমোনের সমস্যা সংশোধন করতে বা টিউমারের আকার ছোট করতে চিকিৎসক হরমোনাল চিকিৎসা বা ওষুধ প্রস্তাব করতে পারেন। যেমন, এসট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন জাতীয় ওষুধ।
- ফাইব্রয়েড অপসারণ (Fibroid Removal):
- যদি টিউমারটি ফাইব্রয়েড (Fibroid) হয়, তবে সাধারণত হিস্টেরেকটমি (Hysterectomy) বা ফাইব্রয়েডের অপসারণ করা হয়। হিস্টেরেকটমি হল জরায়ু পুরোপুরি অপসারণ করা।
- ইনফ্রাসাউন্ড বা এম্বোলাইজেশন (Embolization):
- জরায়ুতে টিউমার হলে, বিশেষত ফাইব্রয়েড হলে, একটি পদ্ধতি ফাইব্রয়েড এম্বোলাইজেশন (Fibroid Embolization) ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে টিউমারের রক্তনালীর মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং টিউমারটি ছোট হয়ে যায়।
- রেডিওথেরাপি (Radiotherapy):
- কিছু ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের জন্য রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হতে পারে, যাতে টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করা যায় এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা যায়।
- সার্জারি (Surgery):
- যদি টিউমারটি বড় আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ না করে, তাহলে সার্জারি করা হতে পারে, যেখানে টিউমার বা জরায়ু অপসারণ করা হয়।
- শল্যচিকিৎসা (Laparoscopy):
- ছোট বা অল্প পরিমাণে টিউমার হলে, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হতে পারে, যাতে ক্ষুদ্র কাট দিয়ে টিউমার অপসারণ করা হয়।
- নিউজ হরমোনাল থেরাপি (New Hormonal Therapy):
- জরায়ু টিউমারের জন্য আধুনিক হরমোনাল থেরাপি, যেমন লিউপ্রোলাইড (Leuprorelin), যা এস্ট্রোজেনের স্তর কমিয়ে টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে।
জরায়ুতে টিউমার প্রতিরোধ:
জরায়ু টিউমারের প্রতিরোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়, তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা যায়:
- সুষম খাদ্যাভ্যাস:
- পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, বিশেষত সঠিক পরিমাণে ভিটামিন A, C, এবং D খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের সুষম বিকাশ নিশ্চিত করা।
- নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা:
- বছরে একবার বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর চিকিৎসকের কাছে গিয়ে গাইনোকোলজিক্যাল পরীক্ষা করা উচিত, যাতে টিউমার বা ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়তে পারে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন কমানো, নিয়মিত ব্যায়াম করা, এবং সঠিক জীবনযাপন বজায় রাখা জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- হরমোন ব্যবস্থাপনা:
- গর্ভনিরোধক পিল ব্যবহার বা অন্য হরমোন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হরমোনের সঠিক মাত্রা বজায় রাখা।
শেষ কথা:
জরায়ুতে টিউমার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনাইন বা নিরাপদ হলেও, ম্যালিগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি সময়মতো চিকিত্সা না করলে সমস্যা তৈরি করতে পারে। সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই ধরনের টিউমার শনাক্ত করা সম্ভব, এবং চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া উচিত।