গিটেগিটে ব্যথা (Frozen Shoulder বা Adhesive Capsulitis) একটি শারীরিক সমস্যা, যেখানে কাঁধের জয়েন্টের চারপাশে পেশী, স্নায়ু, এবং অন্যান্য নরম টিস্যু (যেমন শোল্ডার ক্যাপসুল) শক্ত হয়ে যায় এবং কাঁধের গতি সীমিত হয়ে যায়। এটি সাধারণত অনেক সময় ধরে চলতে থাকে এবং এতে কাঁধের মোচড়, ব্যথা এবং গতির অভাব দেখা দিতে পারে।
গিটেগিটে ব্যথার কারণ:
গিটেগিটে ব্যথার মূল কারণ সঠিকভাবে জানা না গেলেও, এটি কিছু নির্দিষ্ট কারণে ঘটতে পারে:
- গাঁটের প্রদাহ (Inflammation):
- কাঁধের জয়েন্টে প্রদাহ হয়ে গেলে শোল্ডার ক্যাপসুলের ভিতরের টিস্যু আলাদা হয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে যায়, যা কাঁধের গতিতে সমস্যা তৈরি করে।
- আঘাত বা ইনজুরি (Injury or Trauma):
- কাঁধে আঘাত, যেমন দুর্ঘটনা বা অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে, শোল্ডার ক্যাপসুলে আঘাত লাগলে গিটেগিটে ব্যথা হতে পারে।
- গর্ভাবস্থা (Post-Surgery or Immobilization):
- কাঁধের অস্ত্রোপচার বা দীর্ঘসময় ধরে কাঁধ না চলা (যেমন গিপস বা ব্যান্ডেজ দিয়ে রাখা) গিটেগিটে ব্যথার কারণ হতে পারে।
- ডায়াবেটিস (Diabetes):
- ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে গিটেগিটে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এটি শরীরের স্নায়ু এবং টিস্যুর মধ্যে কম্প্লিকেশন সৃষ্টি করতে পারে।
- হার্মোনাল পরিবর্তন (Hormonal Changes):
- হার্মোনাল পরিবর্তনের কারণে যেমন, মেয়েদের মধ্যে মেনোপজের সময়ও গিটেগিটে ব্যথা হতে পারে।
- নিউরোলজিক্যাল এবং সিস্টেমিক রোগ (Neurological and Systemic Conditions):
- কিছু সিস্টেমিক রোগ, যেমন পার্কিনসনস ডিজিজ, হ্যাডারন ইত্যাদি, কাঁধের গতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং গিটেগিটে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
- অনেক সময় ধরে না চলা (Long-Term Immobility):
- দীর্ঘ সময় ধরে কাঁধের জয়েন্ট না চললে এটি শক্ত হয়ে যেতে পারে। ফলে, পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং কাঁধের গতিতে সমস্যা দেখা দেয়।
গিটেগিটে ব্যথার লক্ষণ:
গিটেগিটে ব্যথার কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- কাঁধে ব্যথা (Pain in Shoulder):
- প্রথম দিকে গিটেগিটে ব্যথার প্রধান লক্ষণ হল কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। এটি সাধারণত গভীর বা ধারালো ব্যথা হতে পারে। এটি রাতে আরও খারাপ হতে পারে এবং কিছু দৈনন্দিন কাজ যেমন, চুল আঁচড়ানো বা হাত তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।
- কাঁধের গতি সীমিত হওয়া (Restricted Range of Motion):
- কাঁধের গতি অত্যন্ত সীমিত হয়ে যায়। সাধারণত কাঁধ ঘোরানোর, হাত তোলার বা পিছনে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
- বিরক্তি বা অস্বস্তি (Stiffness or Discomfort):
- কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে শরীরের ওই অংশে অস্বস্তি বা টান অনুভূতি থাকতে পারে। এটি বিশেষত সকালের সময় বেশি অনুভূত হয়।
- রাতের ব্যথা (Night Pain):
- বেশিরভাগ সময় গিটেগিটে ব্যথা রাতে তীব্র হয়ে ওঠে এবং এটি ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
- ব্যথার স্থান নির্দিষ্ট নয় (Pain in Different Locations):
- কাঁধের এক পাশে ব্যথা হতে পারে, তবে কখনও কখনও তা পুরো কাঁধে বা কাঁধের পাশের অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
গিটেগিটে ব্যথার প্রতিকার:
গিটেগিটে ব্যথার প্রতিকার মূলত সমস্যা নির্ণয়ের ভিত্তিতে হয়। সাধারণত, এটি ধীরে ধীরে সেরে ওঠে, তবে কিছু চিকিৎসা আছে যা ব্যথা কমাতে এবং গতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে:
- ফিজিওথেরাপি (Physiotherapy):
- ফিজিওথেরাপি গিটেগিটে ব্যথার অন্যতম প্রধান চিকিৎসা। বিশেষত কাঁধের পেশী এবং জয়েন্টের জন্য স্ট্রেচিং এবং শক্তিশালী ব্যায়াম করা প্রয়োজন। এটি কাঁধের গতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর।
- ওষুধ (Medications):
- ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে প্রাথমিকভাবে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (যেমন আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোকসেন) ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, এটি কেবল ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, সঠিক চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- স্টেরয়েড ইনজেকশন (Steroid Injections):
- যদি ব্যথা খুব তীব্র হয়ে যায়, তবে চিকিৎসক স্টেরয়েড ইনজেকশন প্রদান করতে পারেন, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- হট বা কোল্ড থেরাপি (Hot or Cold Therapy):
- গিটেগিটে ব্যথার ক্ষেত্রে শারীরিক ব্যথা কমানোর জন্য হট বা কোল্ড থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। ঠাণ্ডা বা গরম পানিতে স্নান বা তাপমাত্রা কমানোর ব্যাগ ব্যবহার করলে কিছুটা উপশম পাওয়া যায়।
- অস্ত্রোপচার (Surgery):
- অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে, যদি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর না হয়, তবে অস্ত্রোপচার করা হতে পারে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কাঁধের জয়েন্টের ভিতরের আঁটাভাব বা শক্ত টিস্যু অপসারণ করা হতে পারে। তবে এটি সাধারণত শেষ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- আরাম এবং বিশ্রাম (Rest and Comfort):
- কাঁধের জয়েন্টে চাপ কমানোর জন্য বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। এটি আরও সমস্যা সৃষ্টি হওয়া প্রতিরোধ করতে পারে।
- অ্যানালগেসিক ক্রিম (Topical Analgesic Creams):
- ব্যথা কমানোর জন্য কিছু টপিক্যাল ক্রিমও ব্যবহার করা যেতে পারে যা কাঁধের পেশীতে মাখলে উপশম হতে পারে।
শেষ কথা:
গিটেগিটে ব্যথা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হতে পারে, তবে সঠিক চিকিৎসা ও মনোযোগী যত্নের মাধ্যমে এটি ভালো করা সম্ভব। বিশেষ করে ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি ব্যথা বা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।