গর্ভাবস্থায় বমি ও বমিভাব (Morning Sickness):
গর্ভাবস্থায় বমি এবং বমিভাব একটি সাধারণ সমস্যা যা বেশিরভাগ মহিলাই গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস (প্রথম ট্রাইমিস্টারে) অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এটি সাধারণত অল্প সময়ের জন্য থাকে, তবে কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। “মর্নিং সিকনেস” শব্দটি ব্যবহৃত হলেও এটি শুধুমাত্র সকালে নয়, দিনের যেকোনো সময় হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় বমি ও বমিভাবের কারণ:
- হরমোনাল পরিবর্তন:
গর্ভাবস্থায় হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন আসার কারণে বমি ও বমিভাব দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় হিউম্যান প্লেসেন্টাল ল্যাকটোজ হরমোন (hCG) এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়ে, যা এই ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। - গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল (GI) ট্র্যাক্টের পরিবর্তন:
গর্ভাবস্থায় প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্টের পেশী শিথিল হয়ে যায়, ফলে পাচনতন্ত্রের গতিশীলতা কমে যায়, যা বমি ও বমিভাবের কারণ হতে পারে। - ব্লাড সুগারের পরিবর্তন:
গর্ভাবস্থায় শরীরে গ্লুকোজ বা ব্লাড সুগারের হঠাৎ পরিবর্তনও বমি ও বমিভাবের কারণ হতে পারে। যদি দীর্ঘ সময় কিছু না খাওয়া হয়, তবে তা বমি সৃষ্টি করতে পারে। - সুগন্ধ বা খাদ্যতারুণ্যের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা:
গর্ভবতী মহিলারা সাধারণত সুগন্ধ বা কিছু খাবারের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে থাকেন, যা বমি ও বমিভাবের কারণ হতে পারে। মিষ্টি বা মসলাযুক্ত খাবারের গন্ধ বা তীব্র গন্ধে তারা আরো বেশি প্রভাবিত হতে পারেন। - মানসিক চাপ ও উদ্বেগ:
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে তাদের হজম ক্ষমতা কমে যেতে পারে, ফলে বমি ও বমিভাব বাড়তে পারে। - বংশগত কারণে:
কিছু মহিলার বংশগত কারণে গর্ভাবস্থায় বমি এবং বমিভাব বেশি হতে পারে। যদি গর্ভাবস্থায় বমি বা মর্নিং সিকনেসে কোনো এক মহিলা অভিজ্ঞতা থাকে, তবে তার কন্যা বা বোনদের ক্ষেত্রেও এর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গর্ভাবস্থায় বমি ও বমিভাবের লক্ষণ:
- বমি হওয়া:
গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসে একাধিক বার বমি হতে পারে। এটি সাধারণত খাদ্য গ্রহণের পর বা খালি পেটে হতে পারে। - ঘন ঘন বমিভাব:
কিছু মহিলায় বমি খুব ঘন ঘন হতে পারে, যা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসে থাকে। - অস্বস্তি বা মাথা ঘোরানো:
বমির কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং মাথা ঘোরানোর অনুভূতি হতে পারে। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এটি হালকা শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। - খাদ্যবিশেষের প্রতি সংবেদনশীলতা:
গর্ভাবস্থায় কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ শারীরিক অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন তীব্র মসলাযুক্ত বা তেলের খাবার, ডিম, মিষ্টি বা মাংসের গন্ধ। - পেটের অস্বস্তি বা গ্যাস:
গর্ভাবস্থায় বমিভাবের পাশাপাশি পেটে গ্যাস বা অস্বস্তির অনুভূতি থাকতে পারে, যা বমি হওয়াকে আরো তীব্র করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় বমি ও বমিভাবের প্রতিকার:
- খাওয়ার পরিমাণ ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ:
খালি পেটে বেশি সময় না থাকার চেষ্টা করুন। ছোট ছোট পরিমাণে এবং নিয়মিত খাবার গ্রহণ করতে হবে। সকালে উঠে গরম পানি বা শুকনো মিষ্টি বিস্কুট খেতে পারেন, যা বমি কমাতে সাহায্য করতে পারে। - প্রচুর পানি পান করুন:
শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। শরীরে পানির অভাব থাকলে তা বমি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। - হালকা খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন:
অতিরিক্ত মসলাযুক্ত, তেলতেলে বা ভারী খাবার খাওয়ার পরিবর্তে হালকা ও সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন। যেমন: সাদা ভাত, পাস্তা, স্যুপ, সেদ্ধ আলু ইত্যাদি। - ভিটামিন বি৬ সাপ্লিমেন্ট:
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন বি৬ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে গর্ভাবস্থায় বমি কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। - বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ কমানো:
গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করুন। এক্সারসাইজ বা সহজ যোগব্যায়াম সাহায্য করতে পারে। - তাজা বাতাসে সময় কাটান:
ঘরের মধ্যে প্রচুর সময় কাটানোর কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। তাজা বাতাসে কিছু সময় কাটালে শরীর তাজা বোধ করবে এবং বমি কমাতে সাহায্য করতে পারে। - আলট্রাসাউন্ড বা ম্যানেজমেন্ট থেরাপি:
যদি বমি অত্যন্ত তীব্র হয়ে যায় এবং মা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, তবে চিকিৎসকরা অতিরিক্ত বমি প্রতিরোধ করতে নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা বা চিকিৎসা পদ্ধতি (যেমন, IV তরল বা ড্রাগ) নির্ধারণ করতে পারেন। - ওষুধ গ্রহণ:
কিছু ক্ষেত্রে, যদি বমি খুব বেশি হয়ে যায় এবং মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, তবে চিকিৎসক কিছু নিরাপদ ওষুধ (যেমন, ডিক্লোরমিন) পরামর্শ দিতে পারেন। তবে যেকোনো ধরনের ওষুধের ব্যবহার অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনায় হতে হবে।
উপসংহার:
গর্ভাবস্থায় বমি ও বমিভাব সাধারণত স্বাভাবিক, তবে এটি কিছু মহিলার জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর হতে পারে। সাধারণত এটি প্রথম তিন মাসের মধ্যে থাকে এবং পরবর্তীতে তা কমে যায়। তবে যদি বমি অত্যন্ত তীব্র হয়ে যায় এবং শরীরের দুর্বলতা বাড়ায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।