গতি অসুস্থতা (Motion Sickness) হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি গতি বা চলন্ত পরিবহনে (যেমন: গাড়ি, ট্রেন, বিমান, নৌকা ইত্যাদি) চলাচল করার সময় অস্বস্তি বা অসুস্থতা অনুভব করে। এটি সাধারণত তীব্র মাথাব্যথা, মূর্ছনা, বমি, এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করে। গতি অসুস্থতা তখন ঘটে যখন আপনার চোখ এবং inner ear (শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী অংশ) আপনার চলাচলকে আলাদা ভাবে অনুভব করে, এবং মস্তিষ্ক এই দুটি সংকেতকে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে প্রক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়।
কারণ:
গতি অসুস্থতা সাধারণত নিম্নলিখিত কারণে হতে পারে:
- দৃষ্টির অমিল: যখন আপনি কোনো চলন্ত বাহনে থাকেন এবং আপনি আপনার আশেপাশে স্থির বস্তুগুলো দেখতে পান, তবে আপনার চোখ মস্তিষ্ককে জানায় যে আপনি স্থির আছেন। কিন্তু, আপনার inner ear (শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী অংশ) জানায় যে আপনি চলছেন, এই দুটি সংকেত মস্তিষ্কে অমিল তৈরি করে এবং এর ফলে গতি অসুস্থতা হয়।
- অতিরিক্ত গতি বা ঝাঁকুনি: গাড়ি বা বিমান যদি খুব দ্রুত বা অস্বাভাবিকভাবে চলাচল করে বা যদি কখনো খুব বেশি ঝাঁকুনি হয়, তখন এটি গতি অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
- অস্বস্তিকর পরিবেশ: ঘর বা গাড়ির মধ্যে গরম, অস্বস্তি বা দুর্গন্ধও গতি অসুস্থতার কারণে হতে পারে।
- অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া: চলন্ত বাহনের ভিতরে পড়া, ফোনে কাজ করা, বা কোনো স্থির বস্তুর দিকে তাকিয়ে থাকা গতি অসুস্থতার আশঙ্কা বাড়াতে পারে।
- মানসিক অবস্থা: কিছু ব্যক্তির জন্য মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা স্ট্রেসও গতি অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
লক্ষণ:
গতি অসুস্থতার লক্ষণগুলি সাধারণত নিম্নরূপ:
- মাথাব্যথা: গতি অসুস্থতা হলে সাধারণত মাথাব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণত মাথার সামনের বা পিছনের অংশে হয়ে থাকে।
- মূর্ছনা ও বমি: এটি গতি অসুস্থতার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ, যেখানে অনুভূত হয় বমি করার তীব্র ইচ্ছা বা গ্যাস্ট্রিক প্রবল হয়।
- অস্বস্তি বা ঝিমুনি: খুব দ্রুত গতি বা অধিক ঝাঁকুনি থাকার কারণে অস্বস্তি বা ঝিমুনি অনুভূত হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট বা গা গোলানো অনুভূতি: দ্রুত গতি ও অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে শ্বাসকষ্ট বা গা গোলানো হতে পারে।
- ঘেমে যাওয়া: অধিক গরম বা অস্বস্তিকর পরিবেশে গতি অসুস্থতা হলে ঘেমে যাওয়া হতে পারে।
- চোখের সামনে কালো দেখা: কিছু ক্ষেত্রে, গতি অসুস্থতার ফলে চোখের সামনে কালো বা অন্ধকার দেখা দিতে পারে।
প্রতিকার:
গতি অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে কিছু কার্যকর প্রতিকার রয়েছে, যেমন:
- চলন্ত বাহনে সঠিক স্থান বেছে নেওয়া:
- গাড়ি বা ট্রেনে সামনের দিকে তাকান এবং রাস্তাকে স্পষ্টভাবে দেখুন। বিমান বা নৌকায় বসলে জানালার পাশে বসা ভালো।
- গাড়ির সামনের সিটে বসলে গতি অসুস্থতা কম হতে পারে।
- দৃষ্টি ও ভারসাম্যের সঙ্গতি রাখা:
- যতটা সম্ভব, পঠন বা ফোনে মনোযোগ না দিয়ে পরিবেশের দিকে মনোযোগ দিন।
- কোনো স্থির বস্তু (যেমন: পাহাড় বা বাড়ি) লক্ষ্য করুন, এটি দৃষ্টি ও ভারসাম্যের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করতে সাহায্য করতে পারে।
- বিশ্রাম নেওয়া এবং শিথিলতা:
- গতি অসুস্থতা অনুভব করলে, বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করুন। শরীরকে শিথিল রাখা এবং লম্বা শ্বাস নেওয়া সাহায্য করতে পারে।
- তাজা বাতাস নেওয়া:
- পরিবহনে যদি সম্ভব হয়, তাজা বাতাস নেওয়ার চেষ্টা করুন। এটি শরীরের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- পানি ও খাবার খাওয়া:
- পানি পান করা এবং হালকা, সহজপাচ্য খাবার খাওয়া গতি অসুস্থতা কমাতে সহায়ক হতে পারে। ভারী বা তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- প্রাকৃতিক প্রতিকার:
- আদা: আদা গতি অসুস্থতার জন্য খুবই উপকারী। আদা চা বা আদার টুকরো খাওয়া অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- মিন্ট: মিন্টের তাজা পাতা বা মিন্ট চা খাওয়াও গতি অসুস্থতা কমাতে সহায়ক।
- ঔষধ বা মেডিকেশন:
- যদি প্রাকৃতিক প্রতিকার কাজ না করে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ওষুধ নিতে পারেন, যেমন:
- ডিমেনিহাইড্রিনেট (Dimenhydrinate): এটি একটি সাধারণ অ্যান্টিহিস্টামিন যা গতি অসুস্থতা কমাতে ব্যবহৃত হয়।
- মেকলিজিন (Meclizine): এটি আরও একটি ওষুধ যা গতি অসুস্থতার লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
- স্কোপোলামিন (Scopolamine): এটি একটি প্লাস্টার যা গতি অসুস্থতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এবং এটি সাধারণত পেছনের অংশে কানে লাগিয়ে ব্যবহৃত হয়।
- যদি প্রাকৃতিক প্রতিকার কাজ না করে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ওষুধ নিতে পারেন, যেমন:
চিকিৎসকের পরামর্শ:
গতি অসুস্থতা যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে বা খুবই গুরুতর হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি পরামর্শ দিতে পারেন যা গতি অসুস্থতার জন্য কার্যকর হতে পারে।