ক্ষত পেটে গভীর (Perforated Stomach Ulcer / Perforated Peptic Ulcer) হল একটি গম্ভীর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে পেটে বা অন্ত্রে কোনো আলসার (ulcer) ভেঙে গিয়ে তার মধ্যে থাকা রক্ত, খাবার, গ্যাস এবং এসিড বের হয়ে পেটের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি এক ধরনের গভীর ক্ষত এবং এটি এক্সট্রিম পরিমাণে বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এটি জীবাণু বা ইনফেকশনের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।
কারণ:
ক্ষত পেটে গভীর হওয়ার মূল কারণ হল পেটের বা অন্ত্রের দেয়ালে থাকা আলসারের (Ulcer) বড় হওয়া এবং অবশেষে ভেঙে যাওয়া। কিছু সাধারণ কারণ নিচে দেওয়া হলো:
- হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি (Helicobacter pylori) সংক্রমণ:
- এটি একটি ব্যাকটেরিয়া যা পেটের ভেতরে আলসার তৈরি করতে পারে। যদি এই আলসার দীর্ঘসময় চলতে থাকে এবং সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি পেটের দেয়ালে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদি অ্যান্টি–ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs):
- যেমন অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন ইত্যাদি। এই ওষুধগুলি পেটের শ্লেষ্মা পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যা আলসার সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে।
- অ্যালকোহল সেবন:
অতিরিক্ত অ্যালকোহল খাওয়া পেটের শ্লেষ্মা (mucosal lining) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা আলসার সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘকাল ধরে এটা গভীর হতে পারে। - ধূমপান:
ধূমপান পেটের শ্লেষ্মা কমিয়ে দেয় এবং হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা গভীর আলসার সৃষ্টি করে। - স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ:
অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং স্ট্রেস পেটের আলসারের সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ পেটের দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি গভীর হতে পারে। - অপর্যাপ্ত খাবার এবং খাওয়ার অভ্যাস:
খালি পেটে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া বা সময়মতো খাবার না খাওয়া পেটে অতিরিক্ত এসিড তৈরি করতে পারে, যা আলসারের সৃষ্টি করতে পারে এবং পরবর্তীতে গভীর ক্ষত হয়ে যেতে পারে। - জেনেটিক কারণ:
পরিবারের ইতিহাসে আলসার থাকলে একজন ব্যক্তির মধ্যে আলসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। - অটোইমিউন রোগ:
যেমন লুপাস বা ক্রোনস ডিজিজ, যা পেটের শ্লেষ্মাকে আক্রমণ করতে পারে এবং আলসারের সৃষ্টি করতে পারে।
লক্ষণ:
ক্ষত পেটে গভীর হওয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত দ্রুত এবং তীব্রভাবে বিকশিত হয়। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
- তীব্র এবং প্রবল পেটব্যথা: পেটে খুব তীব্র, ঝনঝনান, এবং গভীর ব্যথা অনুভূত হয়। এটি বিশেষ করে পেটের উপরের অংশে বা পেটে মাঝে অনুভূত হয়। ব্যথা কখনও কখনও খুব তীব্র হয়ে ওঠে এবং ব্যথার সঙ্গে জড়িত হতে পারে।
- বমি বা রক্ত বমি: ক্ষত পেটের মধ্যে গহীন আলসারের কারণে রোগী রক্ত বমি করতে পারে। এটি প্রাথমিক অবস্থায় পেটের রক্তপাত হতে পারে এবং পরে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
- পেটের ফোলা বা চাপ অনুভূতি: পেটের মধ্যে অতিরিক্ত গ্যাস এবং দূষিত উপাদান প্রবাহিত হওয়ার কারণে পেট ফুলে যেতে পারে বা সেখানে চাপ অনুভূত হতে পারে।
- অসুস্থতা, দুর্বলতা এবং তীব্র ক্লান্তি: রক্তপাত ও পেটের আঘাতের কারণে রোগী দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং ক্লান্তি অনুভব করতে পারে।
- জ্বর:
শরীরের মধ্যে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়লে তীব্র জ্বর হতে পারে। এটি গুরুতর ক্ষত বা পেটের পেরফোরেশন থেকে হতে পারে। - শ্বাসকষ্ট বা ডিহাইড্রেশন:
রক্তপাত ও পেটের ভিতরে ক্ষতি হওয়া কারণে শরীরে পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি হতে পারে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট এবং ডিহাইড্রেশন হতে পারে। - মল রক্তাক্ত হওয়া: যদি ক্ষত আলসারের কারণে পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে, তবে মলের মধ্যে রক্তের উপস্থিতি দেখা দিতে পারে, যা ‘টার-লাইক’ (tar-like) বা কালো রঙের মল হতে পারে।
প্রতিকার:
ক্ষত পেটে গভীর হওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যা খুব গুরুতর হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিছু সাধারণ প্রতিকার নিচে দেওয়া হলো:
- অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
যদি হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি সংক্রমণের কারণে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হতে পারে। - অ্যাসিড ব্লকিং ড্রাগস:
পেটের এসিড নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রটন পাম্প ইনহিবিটার (PPIs) বা এইচ2 ব্লকারস দেওয়া হতে পারে। এর মাধ্যমে আলসার থেকে এসিডের প্রভাব কমিয়ে ক্ষত নিরাময় করা যায়। - অপারেশন (Surgical Intervention):
যদি পেটের ক্ষত গুরুতর এবং পেরফোরেশন অনেক বড় হয়ে যায়, তবে সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি দ্বারা পেটের ক্ষত মেরামত করা হয় এবং রক্তপাত থামানো হয়। - ভাল খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন:
- অ্যালকোহল, ধূমপান এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা উচিত।
- নিয়মিত খাবার খাওয়া এবং কম চর্বিযুক্ত, সহজে হজমযোগ্য খাবার গ্রহণ করা উচিত।
- স্ট্রেস কমানোর জন্য যোগব্যায়াম বা ধ্যান করা।
- অ্যানালজেসিক ও পেইন ম্যানেজমেন্ট:
পেটের ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হতে পারে, তবে NSAIDs থেকে দূরে থাকা উচিত, কারণ এটি আলসারের পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। - এনজিওগ্রাফি বা অন্যান্য পরীক্ষা:
কখনও কখনও রক্তপাত বা গভীর ক্ষত সনাক্ত করতে এনজিওগ্রাফি বা অন্য পরীক্ষা করা হতে পারে।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- যদি পেটে তীব্র ব্যথা থাকে যা দ্রুত বাড়ছে।
- যদি বমি করার সময় রক্ত বের হয়।
- যদি পেট ফুলে যায় বা চাপ অনুভূত হয়।
- যদি শরীরে ডিহাইড্রেশন, দুর্বলতা, বা জ্বর থাকে।
- যদি মলে রক্ত থাকে বা মলের রঙ অস্বাভাবিক হয়ে যায় (কালো বা তামাটে)।
ক্ষত পেটে গভীর হওয়া একটি জরুরি পরিস্থিতি এবং এটি অবহেলা করলে জীবনধৈর্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে।