কোলাইটিস (Colitis) হল আন্ত্রিক সিস্টেমের একটি রোগ, যা মূলত মলাশয়ের প্রদাহ বা ফোলাভাবকে নির্দেশ করে। এটি হজমের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন সংক্রমণ, অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া বা প্রদাহজনিত রোগ। কোলাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরনের মধ্যে রয়েছে ইরিটেবল বাওয়েল ডিজিজ (IBD) এবং ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD), যার মধ্যে ক্রোনস ডিজিজ ও উলসারেটিভ কোলাইটিস অন্তর্ভুক্ত।
কারণ:
কোলাইটিসের বিভিন্ন কারণ হতে পারে, এবং রোগটি উপসর্গ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। সাধারণ কারণগুলো হল:
- ইনফেকশন:
- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা প্রোটোজোয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে মলাশয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত খাদ্য বা পানির মাধ্যমে এই ইনফেকশন ছড়ায়।
- প্রদাহজনিত রোগ:
- উলসারেটিভ কোলাইটিস (Ulcerative Colitis): এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ, যা মলাশয়ের অন্ত্রের অভ্যন্তরের শ্লৈষ্মিক স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- ক্রোনস ডিজিজ (Crohn’s Disease): এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ, যা মলাশয়ের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব এবং ক্ষত সৃষ্টি করে।
- অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া:
- কোলাইটিস কিছু ক্ষেত্রে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) ভুলভাবে নিজেই অন্ত্রের কোষকে আক্রমণ করার কারণে ঘটে।
- এন্টিবায়োটিকের প্রভাব:
- কিছু চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কোলাইটিস হতে পারে, যেমন Clostridium difficile (C. difficile) সংক্রমণ, যা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর হতে পারে।
- ধূমপান এবং জীবনের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস:
- ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা মানসিক চাপও কোলাইটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- জেনেটিক বা পারিবারিক ইতিহাস:
- কিছু ক্ষেত্রে, যদি পরিবারের মধ্যে কেউ কোলাইটিসে আক্রান্ত থাকে, তাহলে অন্যদেরও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লক্ষণ:
কোলাইটিসের লক্ষণগুলি রোগের ধরণ ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ যা কোলাইটিসে দেখা যায় তা হলো:
- পেটের ব্যথা বা অসস্তি:
- কোলাইটিসের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হল পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূতি। এটি বিশেষত মলত্যাগের আগে বা পরে বৃদ্ধি পেতে পারে।
- ডায়রিয়া (অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা):
- বেশিরভাগ সময় কোলাইটিসের রোগীরা পাতলা বা ডায়রিয়া জাতীয় পায়খানা করেন, যা কখনো কখনো রক্তও হতে পারে।
- রক্ত বা শ্লেষ্মা সহ পায়খানা:
- মলাশয়ের প্রদাহের কারণে পায়খানার মধ্যে রক্ত, শ্লেষ্মা বা গা dark ় পদার্থ দেখা দিতে পারে।
- বমি বা বমির অনুভূতি:
- কিছু ক্ষেত্রে, কোলাইটিস রোগী বমি বা বমির অনুভূতি অনুভব করতে পারেন।
- তীব্র মলত্যাগের চাপ (Urgency to Defecate):
- কোলাইটিসের রোগীদের পায়খানা করতে তীব্র চাপ অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে খাবারের পর বা সকালে।
- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি (Febrile):
- কিছু রোগী তাপমাত্রার বৃদ্ধি বা জ্বর অনুভব করতে পারেন, যা প্রদাহের ফলে হয়।
- শক্তি বা ক্ষুধাহীনতা (Fatigue and Loss of Appetite):
- কোলাইটিসের রোগীরা সাধারণত শক্তিহীনতা বা অরুচি অনুভব করতে পারেন।
- ওজন হ্রাস:
- দীর্ঘস্থায়ী কোলাইটিসের কারণে রোগীর ওজন কমতে পারে, কারণ শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি সঠিকভাবে শোষণ করতে পারে না।
প্রতিকার:
কোলাইটিসের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগটির ধরণ, তীব্রতা এবং কারণের উপর। তবে কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি নিচে দেওয়া হল:
- ঔষধ:
- অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (যেমন সলসালাজাইন): প্রদাহ কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ইমিউনোসপ্রেসিভ ওষুধ (যেমন আযাথিওপ্রিন): শরীরের অতিরিক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা (অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া) কমানোর জন্য ব্যবহার হয়।
- স্টেরয়েড (Corticosteroids): প্রদাহ কমাতে ব্যবহার করা হয়, বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল প্রদাহের ক্ষেত্রে।
- এন্টিবায়োটিকস: ইনফেকশনজনিত কোলাইটিসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতে পারে।
- অপিওড বা ডায়রিয়া রোধী ওষুধ: ডায়রিয়া এবং পেটের ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ডায়েট এবং পুষ্টি:
- কোলাইটিসের রোগীদের পুষ্টিকর খাবার খেতে বলা হয়, যেমন ফাইবারের পরিমাণ বেশি খাবার। তবে, কিছু খাবার যেমন মসলাযুক্ত খাবার বা দুধ এড়িয়ে চলা উচিত।
- বিশেষ ডায়েট: কোলাইটিসের কিছু রোগী নির্দিষ্ট খাবার (যেমন ল্যাকটোস বা গ্লুটেন) এড়িয়ে চলেন।
- পরিমাণ মতো পানি পান করা উচিত যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়।
- লিভিং লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
- নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানোর কৌশল যেমন যোগব্যায়াম বা ধ্যান, কোলাইটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
- সার্জারি:
- যদি কোলাইটিস অত্যন্ত তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় এবং ওষুধে কাজ না করে, তবে সার্জারির মাধ্যমে আক্রান্ত অংশ অপসারণ করা হতে পারে। উলসারেটিভ কোলাইটিস বা ক্রোনস ডিজিজে, কখনো কখনো মলাশয় অপসারণ (কোলেক্টমি) প্রয়োজন হতে পারে।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে:
- যদি কোলাইটিসের কারণে তীব্র পেটের ব্যথা, প্রচুর রক্তপাত, তীব্র ডায়রিয়া বা অবসাদ হয়ে থাকে।
- যদি শরীরের তাপমাত্রা অনেক বাড়ে (জ্বর)।
- যদি পায়খানায় রক্ত বা শ্লেষ্মা দেখা দেয়।
প্রতিরোধ:
- কোলাইটিসের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিরোধের উপায় নেই, তবে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান, স্ট্রেস কমানো এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।