কোয়াশিয়রকর (Kwashiorkor) হলো একটি গুরুতর পুষ্টির অভাবজনিত রোগ, যা সাধারণত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি মূলত প্রোটিনের অভাবে ঘটে এবং শিশুর দেহে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলা (এডিমা), পুষ্টিহীনতা এবং অন্যান্য গুরুতর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
কোয়াশিয়রকর এর কারণ:
কোয়াশিয়রকর মূলত প্রোটিনের অভাবে ঘটে, যদিও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের অভাবও এতে অবদান রাখতে পারে। প্রধান কারণ হলো:
- প্রোটিনের অভাব:
- কোয়াশিয়রকর মূলত প্রোটিনের অভাবে হয়। শিশু পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ না করলে তাদের শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। প্রোটিন শরীরে এন্টিবডি তৈরি করতে, টিস্যু রিপেয়ার করতে, এবং শক্তি সরবরাহে সাহায্য করে।
- খাদ্য অভাব:
- খাদ্যে পর্যাপ্ত প্রোটিন না থাকা, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে যেখানে শিশুরা অপর্যাপ্ত বা একপেশে খাবার খায় (যেমন, ভাত বা মিষ্টি খাদ্য), কোয়াশিয়রকর হতে পারে।
- পুষ্টির অভাব:
- প্রোটিন ছাড়াও ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব (যেমন, ভিটামিন A, B, আয়রন, ক্যালসিয়াম) কোয়াশিয়রকর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
- শিশুর বয়স:
- কোয়াশিয়রকর সাধারণত ১ থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, কারণ এই বয়সে তাদের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং তাদের পুষ্টির চাহিদা বেশি হয়।
- অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা:
- দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বা ইনফেকশন (যেমন ডায়েরিয়া, কৃমি) প্রোটিন শোষণ কমাতে পারে, যা কোয়াশিয়রকর হতে পারে।
কোয়াশিয়রকর এর লক্ষণ:
- শরীরের ফোলা (এডিমা):
- কোয়াশিয়রকর এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব (এডিমা)। বিশেষ করে পায়ের, পেটের, হাতের, এবং চোখের চারপাশে ফোলাভাব দেখা যায়।
- শক্তি ও শারীরিক দুর্বলতা:
- শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, তাকে চলাফেরা বা খেলাধুলা করতে অসুবিধা হয়। শক্তির অভাব, ক্লান্তি এবং মেজাজের পরিবর্তনও দেখা দিতে পারে।
- বিকৃত চামড়া এবং চুল:
- চামড়া পুরু হয়ে যায়, শুষ্ক এবং ফাটা হতে পারে। এছাড়া শিশুর চুলও পাতলা, রুক্ষ বা সাদা হয়ে যেতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে চুল পড়াও শুরু হতে পারে।
- খাওয়ার প্রতি অনীহা:
- শিশুর খিদে কমে যায় এবং সে খাবারের প্রতি অনীহা দেখায়। এটি প্রোটিনের অভাবের কারণে ঘটে।
- বৃদ্ধির অভাব:
- শিশু অনেক ধীরে বা থেমে থেমে বৃদ্ধি পেতে পারে। তার উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কমে যায়।
- ডায়রিয়া বা ইনফেকশন:
- কোয়াশিয়রকর আক্রান্ত শিশুর শরীরে ডায়রিয়া বা অন্যান্য ইনফেকশন দেখা দিতে পারে, কারণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
- বিভ্রান্তি ও মানসিক অবস্থা:
- শিশুর মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে, যেমন অস্থিরতা, অবহেলা, বা মনোযোগের অভাব।
- পেটের সমস্যাগুলি:
- কোয়াশিয়রকর এর কারণে শিশুর পেটে গ্যাস, ব্যথা বা অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পেট ফুলে যেতে পারে।
কোয়াশিয়রকর এর প্রতিকার:
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার:
- কোয়াশিয়রকর প্রতিরোধ বা চিকিৎসার প্রধান উপায় হলো শিশুকে পর্যাপ্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া। প্রোটিনের ভালো উৎস যেমন মাংস, মছ, ডিম, দুধ, পনির, দই, মুগ ডাল, শিম ইত্যাদি শিশুর খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
- ভিটামিন ও মিনারেল:
- ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাকসবজি, ফল, দুধ, সয়া মিল্ক, ডিম, শস্য, বাদাম ইত্যাদি খাবার প্রদান করা উচিত। এতে শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূর্ণ হবে এবং শারীরিক বৃদ্ধি ভালো হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ:
- কোয়াশিয়রকর গুরুতর অবস্থায়, চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিশুর শরীরে ফোলা, ডায়রিয়া বা অন্যান্য গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে, চিকিৎসক দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন।
- ইনফেকশন প্রতিরোধ:
- কোয়াশিয়রকর সাধারণত পুষ্টির অভাবে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায়, ফলে শিশু সহজে সংক্রমণ হতে পারে। তাই শিশুদের সুস্থ রাখতে সব ধরনের ইনফেকশন প্রতিরোধে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
- শিশুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ:
- পুষ্টিহীনতার জন্য শিশুর স্বাস্থ্য নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং তার খাদ্যাভ্যাসে উন্নতি আনা প্রয়োজন।
- জলপান ও হাইড্রেশন:
- পর্যাপ্ত পানি এবং তরল খাবার যেমন স্যুপ, ফলের রস, দুধ ইত্যাদি শিশুকে সরবরাহ করা উচিত। শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।
- প্রোটিন সমৃদ্ধ পরিপূরক:
- কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসক শিশুকে প্রোটিন বা ক্যালোরি সমৃদ্ধ পরিপূরকও দিতে পারেন। এতে শিশুর শরীরে পুষ্টি দ্রুত পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
- কীটনাশক এবং কৃমির ওষুধ:
- যদি শিশুর পেটে কৃমি বা অন্য কোনো পরজীবী থাকে, তবে তাদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন, কারণ কৃমি বা পরজীবী শিশুদের শরীর থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারে, যা কোয়াশিয়রকর সৃষ্টি করে।
শেষ কথা:
কোয়াশিয়রকর একটি গুরুতর পুষ্টির অভাবজনিত রোগ, যা প্রধানত প্রোটিনের অভাবে ঘটে। যথাযথ পুষ্টি, প্রোটিন, ভিটামিন, এবং মিনারেলের অভাব পূর্ণ করতে শিশুকে সঠিক খাবার দেওয়া এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া জরুরি। কোয়াশিয়রকর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত, যাতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধিত হয়।
Top of Form