কুচকি ফোলা (Mumps) হলো একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যা সাধারণত প্যারামিক্সোভাইরাস (Paramyxovirus) দ্বারা ঘটে। এটি সাধারণত গাল ও কানের আশপাশের গ্রন্থিতে ফোলাভাব সৃষ্টি করে, বিশেষ করে পারোটিড গ্রন্থি (parotid glands) যা মুখের পাশে গালের নিচে থাকে। কুচকি ফোলা একটি সংক্রামক রোগ এবং এটি এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কারণ:
কুচকি ফোলার প্রধান কারণ হলো মাম্পস ভাইরাস (Mumps virus)। এটি ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ঘটে এবং মূলত শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায়।
- ভাইরাস সংক্রমণ:
- মাম্পস ভাইরাস মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়, যেমন কাশি, হাঁচি, কথা বলা, বা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে।
- বিশেষত শিশুদের মধ্যে:
- কুচকি ফোলা সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে বড়দেরও আক্রান্ত হতে পারে। ২ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এটি বেশি প্রচলিত।
- প্রতিরোধহীনতা:
- যদি কেউ মাম্পসের টিকা (MMR vaccine) না নেয়, তবে তাদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
লক্ষণ:
কুচকি ফোলার কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- গালে ফোলা বা গামছা:
- সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো গাল বা কানের নিচে এক বা উভয় পাশে ফোলাভাব। এটি গালের খুব নীচের দিকে অনুভূত হয়, যা সময়ের সাথে সাথে আরো বড় হতে পারে।
- তীব্র ব্যথা:
- ফোলা স্থানে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে খাওয়ার সময় বা কথা বলার সময়।
- জ্বর:
- আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা সাধারণত মাঝারি থেকে উচ্চমানের জ্বর হতে পারে।
- মাথাব্যথা ও দুর্বলতা:
- সাধারণ মৃদু মাথাব্যথা এবং দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে।
- খাওয়ার অস্বস্তি:
- গাল ফোলার কারণে খাওয়ার সময় বিশেষ করে টক খাবার খেতে অস্বস্তি হতে পারে।
- সাধারণ শীতল লকন:
- কিছু মানুষ শীতল বা ঠান্ডা লাগার অনুভূতি ও ক্ষীণ শরীরের অন্যান্য লক্ষণ অনুভব করতে পারে।
প্রতিকার:
কুচকি ফোলা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের দ্বারা নিরাময় হয় না কারণ এটি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। তবে কিছু কার্যকর প্রতিকার এবং যত্ন নেয়া যেতে পারে:
- বিশ্রাম ও পানি পান:
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।
- জ্বর ও ব্যথা কমানোর ঔষধ:
- জ্বর বা শরীরের ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, অ্যাসপিরিন ব্যবহার এড়ানো উচিত, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, কারণ এটি একটি গুরুতর রোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যেমন রেয়স সিনড্রোম (Reye’s syndrome)।
- টিকা গ্রহণ:
- কুচকি ফোলা প্রতিরোধে MMR ভ্যাকসিন (Measles, Mumps, Rubella) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই টিকা গ্রহণের মাধ্যমে কুচকি ফোলার ঝুঁকি কমে যায়। সাধারণত শিশুদের ১ বছর বয়সের পর এবং আবার ৪-৬ বছর বয়সে টিকা দেওয়া হয়।
- গরম বা ঠান্ডা চাপ ব্যবহার:
- গালের ফোলা স্থানে গরম বা ঠান্ডা চাপ প্রয়োগ করলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেতে পারে।
- ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা:
- আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য তাকে আলাদা রাখা উচিত। এছাড়া, টিকা গ্রহণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার।
- স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ:
- যদি উপসর্গগুলো গুরুতর হয়ে ওঠে বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, যেমন আংশিক বা সম্পূর্ণ শোনার সমস্যা (যদি কানের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে যায়), তাহলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সতর্কতা:
- কুচকি ফোলা ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় সংক্রমণ রোধ করতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলা উচিত।
- ভালো হাইজিন বজায় রাখা, যেমন হাত ধোয়া এবং টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা, ভাইরাসের বিস্তার কমাতে সাহায্য করে।
- টিকা দেওয়ার মাধ্যমে কুচকি ফোলা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কুচকি ফোলার ফলস্বরূপ জটিলতা:
মাম্পস সাধারণত শিশুদের মধ্যে একটি হালকা সংক্রমণ হলেও, কখনও কখনও এটি কিছু গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে:
- যৌনগ্রন্থি প্রদাহ (Orchitis):
- কিছু ক্ষেত্রে, পুরুষদের মধ্যে কুচকি ফোলার কারণে যৌনগ্রন্থিতে প্রদাহ হতে পারে, যা প্রজননক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।
- মস্তিষ্কের প্রদাহ (Encephalitis):
- এই রোগের কারণে মস্তিষ্কের প্রদাহ হতে পারে, যা একটি জীবনহানিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যদিও এটি খুবই বিরল।
- শোনার সমস্যা (Hearing Loss):
- কুচকি ফোলা কখনও কখনও কান এবং শ্রবণনালি সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে কিছু মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে।
কুচকি ফোলা একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ হলেও সঠিক সময়মতো চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি ভালোভাবে নিরাময় সম্ভব।