কিডনী প্রদাহ (Kidney Inflammation) বা নেফ্রাইটিস (Nephritis) হলো কিডনির প্রদাহজনিত একটি অবস্থা, যেখানে কিডনির কাঠামো বা স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি কিডনির ফাংশন কমিয়ে দিতে পারে এবং সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে চললে কিডনির ক্রনিক রোগে পরিণত হতে পারে।
কারণ:
কিডনির প্রদাহের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ হল:
- মূত্রনালী সংক্রমণ (Urinary Tract Infection – UTI):
- দীর্ঘ সময় ধরে untreated মূত্রনালী সংক্রমণ কিডনিতে ছড়িয়ে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- অটোইমিউন রোগ (Autoimmune Diseases):
- সিস্টেমিক লুপাস এরিথেম্যাটোসাস (SLE), গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস (Glomerulonephritis) ইত্যাদি রোগ কিডনির প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এসব রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা স্বাভাবিক টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ করে।
- ভাইরাল সংক্রমণ (Viral Infections):
- ভাইরাল সংক্রমণ যেমন হেপাটাইটিস বা এইচআইভি কিডনির প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ (Bacterial Infections):
- ব্যাকটেরিয়ার কারণে কিডনির প্রদাহ হতে পারে, বিশেষত স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণ।
- ডায়াবেটিস (Diabetes):
- দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিস কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং তার ফলে কিডনির প্রদাহ হতে পারে।
- হাইপারটেনশন (High Blood Pressure):
- উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ছেঁকা বা ফিল্টারিং ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং প্রদাহের কারণ হতে পারে।
- অ্যালার্জি (Allergic Reactions):
- কিছু ঔষধ বা প্রাকৃতিক উপাদান কিডনির প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে যদি শরীরের অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হয়।
- টক্সিন বা স্যাল্ট বেশি খাওয়া (Excessive Toxins or Salt Intake):
- অতিরিক্ত টক্সিন বা লবণ কিডনির উপরে চাপ সৃষ্টি করে, এবং প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।
- ড্রাগ রিঅ্যাকশন (Drug Reactions):
- কিছু ঔষধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক কিডনির প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
লক্ষণ:
কিডনির প্রদাহের লক্ষণগুলি ব্যক্তি এবং প্রদাহের কারণ অনুসারে বিভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
- পিঠে বা কিডনির পাশে ব্যথা (Back or Flank Pain):
- কিডনির প্রদাহে কিডনির নিচে বা পিঠের অংশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- মূত্রে পরিবর্তন (Urinary Changes):
- মূত্রের রঙ পরিবর্তন হতে পারে (লাল, গোলাপি বা মেঘলা), এবং মূত্রের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে। মূত্রে রক্ত বা প্রোটিনও থাকতে পারে।
- ফুলে ওঠা (Swelling):
- কিডনির প্রদাহের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে ওঠা হতে পারে, বিশেষ করে পা, হাত, মুখ এবং চোখের নিচে।
- উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure):
- কিডনির প্রদাহের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, কারণ কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- বমি ও বমিভাব (Nausea and Vomiting):
- কিডনির ফাংশন কমে গেলে বমি বা বমিভাব হতে পারে।
- শরীরের অতিরিক্ত ক্লান্তি (Fatigue):
- কিডনির প্রদাহের কারণে শরীরের শক্তি কমে যায় এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
- অতিরিক্ত প্রোটিন বা পটাসিয়াম (Protein or Potassium in Blood):
- রক্তে প্রোটিন বা পটাসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার লক্ষণ।
- অ্যাপেটাইট কমে যাওয়া (Loss of Appetite):
- কিডনির সমস্যার কারণে খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে এবং এর ফলে ওজন কমে যেতে পারে।
- গরম অনুভূতি ও জ্বর (Fever and Chills):
- কিডনির প্রদাহে কখনও কখনও হালকা বা মাঝারি জ্বর দেখা দিতে পারে, বিশেষত যখন সংক্রমণ থাকে।
প্রতিকার:
কিডনির প্রদাহের চিকিৎসা কারণ অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে কিছু সাধারণ প্রতিকার হলো:
- প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিশ্রাম (Rest and Initial Treatment):
- কিডনির প্রদাহের ক্ষেত্রে প্রথমে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। কোনো সংক্রমণ থাকলে তা নিরাময় করা জরুরি।
- এন্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি (Antibiotics or Antiviral Therapy):
- যদি প্রদাহের কারণ ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস হয়, তবে এন্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি দেওয়া হতে পারে।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ (Blood Pressure Control):
- কিডনি প্রদাহের ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে, তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়েট, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ঔষধ ব্যবহার করা উচিত।
- অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি ঔষধ (Anti-inflammatory Drugs):
- প্রদাহ কমানোর জন্য কিছু অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি (অসুখপ্রতিরোধক) ঔষধ যেমন স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে।
- প্রোটিন কন্ট্রোল (Protein Control in Diet):
- কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কিছু খাবার যেমন মাংস, ডাল ইত্যাদির পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
- পানি ও লবণ কমানো (Reduce Salt and Water Intake):
- কিডনির প্রদাহে অতিরিক্ত পানি বা লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
- অপারেশন বা ডায়ালাইসিস (Dialysis or Surgery):
- যদি কিডনির কার্যক্ষমতা খুব কমে যায়, তাহলে ডায়ালাইসিস (কৃত্রিম রক্ত পরিষ্করণ) প্রয়োজন হতে পারে। কখনও কখনও অস্ত্রোপচারও প্রয়োজন হতে পারে।
- হাসপাতালে ভর্তি (Hospitalization):
- গুরুতর কিডনি প্রদাহের ক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হতে পারে, যেখানে ইনফিউশন বা পর্যবেক্ষণ দেওয়া হবে।
- পুনরায় পরীক্ষা (Follow-up Tests):
- কিডনির প্রদাহের চিকিৎসার পর, কিডনির কার্যক্ষমতা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা উচিত। রক্ত পরীক্ষা এবং মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
- যদি পিঠে বা কিডনির পাশে তীব্র ব্যথা থাকে।
- যদি মূত্রে রক্ত, শিরশির বা মেঘলা হয়ে যায়।
- যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে বা ফুলে ওঠা শুরু হয়।
- যদি শরীরে অতিরিক্ত ক্লান্তি বা বমি দেখা দেয়।
- যদি জ্বর এবং শিরশির অনুভূতি থাকে।
কিডনির প্রদাহ একটি গুরুতর সমস্যা, যা দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে কিডনি ফেইলিওরের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।