কালাজ্বর (Leishmaniasis) হল একটি গুরুতর সংক্রামক রোগ, যা লিশম্যানিয়া নামে একটি পরজীবী (parasite) দ্বারা ঘটে। এই রোগটি সাধারণত এক ধরনের মশা, যাকে ফ্লাই মশা বা স্যান্ড ফ্লাই বলা হয়, এর মাধ্যমে ছড়ায়। কালাজ্বর প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং কিছু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
কালাজ্বরের কারণ:
কালাজ্বরের কারণ হল লিশম্যানিয়া নামক এক ধরনের পরজীবী, যা ফ্লাই মশা (Phlebotomus) দ্বারা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফ্লাই মশা যখন আক্রান্ত মানুষের রক্ত খায়, তখন এই পরজীবী তাদের শরীরে প্রবাহিত হয়। মশার কামড়ের মাধ্যমে এটি শরীরে ঢুকে, বিশেষত যকৃত (liver), পিপঁড়ে (spleen), এবং মজ্জা (bone marrow) আক্রমণ করতে পারে।
এই রোগের দুটি প্রধান ধরন:
- ভিসেরাল লিশম্যানিয়াসিস (Visceral Leishmaniasis) বা কালাজ্বর – এটি গুরুতর এবং প্রাণঘাতী হতে পারে।
- কাটানি লিশম্যানিয়াসিস (Cutaneous Leishmaniasis) – যা ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে।
কালাজ্বরের লক্ষণ:
কালাজ্বরের উপসর্গগুলি সাধারণত ২-৮ মাস পরে প্রকাশ পায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগটি দ্রুতও প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রধান লক্ষণগুলি হল:
- বিরাট রক্তস্বল্পতা (Anemia): রোগীর শরীরে রক্তের অভাব দেখা দিতে পারে, যার ফলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়।
- যকৃত এবং পিপঁড়ে বাড়ানো: যকৃত (liver) এবং পিপঁড়ে (spleen) অনেক বড় হয়ে যেতে পারে, যা পেটের মাঝে ব্যথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
- জ্বর এবং ঘাম: রোগী প্রায়ই উচ্চ জ্বরে ভুগতে পারে, বিশেষ করে রাতের দিকে ঘাম বৃদ্ধি পায়।
- ক্লান্তি এবং দুর্বলতা: রোগী খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাধারণ কাজকর্ম করতে অক্ষম হতে পারে।
- ওজন কমে যাওয়া: রোগী দ্রুত ওজন হারাতে পারে, যা শরীরের শক্তির অভাব নির্দেশ করে।
- ত্বকের ক্ষত: কখনও কখনও ত্বকে ক্ষত বা ঘা তৈরি হতে পারে।
- সতর্কতা এবং অস্থিরতা: রোগী অনেক সময় হতাশ বা অস্থির অনুভব করতে পারে।
কালাজ্বরের প্রতিকার:
কালাজ্বর একটি গুরুতর রোগ, তবে এটি চিকিৎসা করা সম্ভব। রোগটির প্রতিকার এবং প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
১. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা:
কালাজ্বরের চিকিৎসার জন্য কিছু কার্যকরী অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধ রয়েছে:
- অ্যাম্ফোটেরিসিন বি (Amphotericin B): এটি মূলত গুরুতর কালাজ্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
- পারামোমাইসিন (Paromomycin): এটি একটি কার্যকরী ঔষধ যা কালাজ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- মিলটেনটিন (Miltefosine): এটি একটি অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ঔষধ যা কালাজ্বরের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ন্যানো পারামোমাইসিন (Liposomal Amphotericin B): আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এটি ব্যবহৃত হয় এবং এটি কার্যকরী হতে পারে।
২. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
- মশা থেকে সুরক্ষা: স্যান্ড ফ্লাই মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে থাকাকালীন মশা তাড়ানোর ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা উচিত।
- মশা নিধন: বাড়ির আশপাশে পানি জমে না থাকার জন্য খেয়াল রাখা এবং মশা কমানোর জন্য পরিবেশ পরিষ্কার রাখা জরুরি।
- ক্লিন স্যানিটেশন: ভালো স্যানিটেশন এবং পরিষ্কার পরিবেশ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মশার বিস্তার রোধ করা যায়।
৩. স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা পরামর্শ:
কালাজ্বর একটি জীবনধাতকারী রোগ হতে পারে, তাই প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীর যথাযথ চিকিৎসা এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
সারাংশ:
কালাজ্বর একটি গুরুতর সংক্রামক রোগ, যা স্যান্ড ফ্লাই মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি মানুষের যকৃত, পিপঁড়ে এবং অন্যান্য অঙ্গকে আক্রমণ করে। তবে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া হলে এটি সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য। তাই, রোগের প্রথম উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে এবং মশা থেকে সুরক্ষা বজায় রাখতে হবে।