ঋতুস্রাব সিগ্রি হওয়া (Scanty Menstrual Flow or Oligomenorrhea) এমন একটি অবস্থা যেখানে মহিলাদের ঋতুস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম হয়ে থাকে। এটি সাধারণত এক বা দুই দিন ধরে হয়, এবং ঋতুস্রাবের রক্তপাত খুবই হালকা বা অল্প থাকে।
কারণ:
ঋতুস্রাব সিগ্রি হওয়ার বেশ কিছু কারণ হতে পারে। তার মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ হল:
- হরমোনাল অমিল (Hormonal Imbalance):
- হরমোনাল ভারসাম্যের সমস্যা (যেমন ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরনের অভাব) ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম হতে পারে। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে, যেমন স্ট্রেস, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস বা ওজনের সমস্যা।
- পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS):
- পিসিওএস (Polycystic Ovary Syndrome) একটি সাধারণ হরমোনাল অস্বাভাবিকতা, যেখানে মহিলাদের গর্ভাশয়ে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয় এবং ঋতুস্রাব কম বা অনিয়মিত হতে পারে।
- গর্ভধারণের সম্ভাবনা (Pregnancy):
- গর্ভধারণের কারণেও কখনও কখনও ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম হতে পারে বা মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি সাধারণত গর্ভধারণের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়।
- থাইরয়েড সমস্যা (Thyroid Disorders):
- থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা (হাইপোথাইরয়ডিজম বা হাইপারথাইরয়ডিজম) ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমাতে পারে। থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য শরীরের অন্যান্য হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলে এবং ঋতুস্রাবের অনিয়মিততা সৃষ্টি করে।
- ওজনের সমস্যা (Weight Issues):
- অত্যধিক কম বা বেশি ওজন থাকা ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম করতে পারে। বিশেষত অতিরিক্ত শরীরের চর্বি বা খুব কম শরীরের চর্বি ঋতুস্রাবের হরমোনাল ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে।
- অতিরিক্ত শারীরিক কসরত (Excessive Physical Activity):
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা এক্সারসাইজও ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমাতে পারে। বিশেষ করে যারা কঠোর ব্যায়াম করেন, তাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
- স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ (Stress):
- মানসিক চাপ বা উদ্বেগ হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যা ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমাতে পারে।
- গর্ভাশয়ের অবস্থা (Uterine Issues):
- গর্ভাশয়ে কোনো ধরনের সমস্যা বা অসুস্থতা যেমন অঙ্গের অস্বাভাবিকতা, ফাইব্রয়েডস বা পলিপস, এসব কারণে ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম হতে পারে।
- অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়া (Eating Disorders):
- খাদ্যজনিত সমস্যা (যেমন অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়া) শরীরের পুষ্টির অভাব ঘটাতে পারে, যা ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে।
- এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis):
- এন্ডোমেট্রিওসিস একটি অবস্থা যেখানে গর্ভাশয়ের বাইরের টিস্যু বৃদ্ধি পায়, যা মাসিকের সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এবং ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে।
- মেনোপজ (Menopause):
- মেনোপজ বা তার কাছাকাছি সময়ে ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম হতে পারে। মেনোপজের আগে কিছু মহিলাদের ঋতুস্রাবের পরিমাণ হালকা হয়ে যায় এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
লক্ষণ:
ঋতুস্রাব সিগ্রি হওয়ার সাধারণ লক্ষণ গুলি হলো:
- ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম:
- ঋতুস্রাবের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কম বা হালকা হওয়া, যেমন মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তপাত হওয়া।
- ঋতুস্রাবের সময় কম:
- ঋতুস্রাব স্বাভাবিকের তুলনায় কম সময় (১-২ দিন) স্থায়ী হয়।
- স্বাভাবিকের তুলনায় হালকা রক্তপাত:
- ঋতুস্রাবের সময় হালকা রক্তপাত হওয়া বা শিরার মতো হালকা রঙের রক্তপাত।
- অথবা অনিয়মিত ঋতুস্রাব:
- কখনো খুব কম, আবার কখনো নিয়মিত সময়ে না হওয়া, ঋতুস্রাবের অস্বাভাবিকতা।
- গর্ভধারণের লক্ষণ:
- কিছু মহিলার ক্ষেত্রে গর্ভধারণের কারণে ঋতুস্রাব কম হতে পারে, তাই গর্ভধারণের লক্ষণ যেমন বমি, ক্লান্তি, স্তনে ব্যথা, ঘ্রাণ সংবেদনশীলতা বা মূর্ছনা দেখা দিতে পারে।
প্রতিকার:
ঋতুস্রাব সিগ্রি হওয়ার চিকিৎসা মূলত কারণ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়:
- হরমোনাল থেরাপি:
- হরমোনাল সমস্যা, যেমন ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরনের অভাব, চিকিৎসা করা যেতে পারে গর্ভনিরোধক পিল বা অন্য হরমোনাল থেরাপি দ্বারা।
- পিসিওএস চিকিৎসা:
- পিসিওএসের কারণে হরমোনাল অস্বাভাবিকতা থাকলে, চিকিৎসক সাধারণত হরমোনাল থেরাপি বা ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন।
- থাইরয়েড চিকিৎসা:
- থাইরয়েড সমস্যার কারণে যদি ঋতুস্রাব কম হয়, তাহলে থাইরয়েডের চিকিৎসা (যেমন থাইরয়েড হরমোন থেরাপি) প্রদান করা হয়।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ:
- স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অত্যধিক ওজন বা কম ওজন ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমাতে পারে।
- স্ট্রেস কমানো:
- মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমানোর জন্য যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা অন্যান্য শিথিলকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
- এন্ডোমেট্রিওসিস বা গর্ভাশয়ের চিকিৎসা:
- এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য অস্ত্রোপচার বা ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।
- অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়া চিকিৎসা:
- খাদ্যজনিত সমস্যাগুলি চিকিৎসা করা উচিত এবং পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- গর্ভধারণ পরীক্ষা:
- গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকলে, গর্ভধারণ পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
- সুষম খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং নিয়মিত শারীরিক কসরত ঋতুস্রাবের সমস্যার প্রতিকার করতে সহায়ক হতে পারে।
মনে রাখবেন:
ঋতুস্রাবের পরিমাণ কম বা সিগ্রি হওয়া কখনো কখনো স্বাভাবিক হতে পারে, তবে এটি যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে বা অস্বাভাবিক হয়ে থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।