আমাশা (Dysentery) একটি পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, যা পেটের অস্বস্তি, ডায়রিয়া (পায়খানা) এবং শারীরিক দুর্বলতার সাথে যুক্ত থাকে। এটি সাধারণত সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা পরজীবী দ্বারা হয়ে থাকে। আমাশার কারণে পেটের সমস্যা এবং পেটফুলে যাওয়া, বমি, রক্ত বা মিউকাস (পুঁজ) সহ পায়খানার সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
কারণ:
আমাশা হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
- ব্যাকটেরিয়া (Bacterial Infection):
- শিগেলা (Shigella): এটি সবচেয়ে সাধারণ আমাশার কারণ, যা আন্ত্রিক প্রদাহ সৃষ্টি করে।
- স্যালমোনেলা (Salmonella): এটি গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে, এবং সাধারণত খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে ছড়ায়।
- ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার (Campylobacter): এটি পেটের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং সাধারণত খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
- ভাইরাস (Viral Infection):
- নোরোভাইরাস (Norovirus): এটি সাধারণত খাদ্য বা পানি থেকে ছড়ায় এবং প্রায়শই আন্ত্রিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
- রোটাভাইরাস (Rotavirus): এটি শিশুর মধ্যে প্রধানত হয় এবং সাধারণত পায়খানায় লেবু বা সাদা তরল দেখা যায়।
- পরজীবী (Parasites):
- এমিবারিয়াল আমাশা (Amoebic Dysentery): এটি আমিবা নামে পরিচিত একটি পরজীবী দ্বারা হয়, যা পেটের গহ্বরের মধ্যে বসবাস করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে।
- গার্ডিয়া (Giardia): এটি একধরনের পরজীবী, যা পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং পেটের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাবার বা পানি:
- অশুচি পানি বা ময়লা খাবার খেলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, এবং এটি আমাশার প্রধান কারণ হতে পারে।
- পানি এবং খাবারের দূষণ:
- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ময়লা হাত দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস বা অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহার করা আমাশার কারণ হতে পারে।
লক্ষণ:
আমাশার প্রধান লক্ষণগুলো হল:
- অতিরিক্ত পায়খানা (Diarrhea):
- আমাশার ফলে ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে পায়খানা তরল বা পেটফুলে হওয়া, মাঝে মাঝে রক্তসহ হতে পারে।
- পেটব্যথা বা ক্র্যাম্প:
- পেটে তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। এটি বিশেষত পায়খানা চলাকালে বাড়তে পারে।
- বমি এবং বমিভাব:
- বমি বা বমিভাব হতে পারে, যা শরীরের পানির ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
- রক্ত বা মিউকাস (Pus) মিশ্রিত পায়খানা:
- কিছু ক্ষেত্রে, পায়খানায় রক্ত বা মিউকাস দেখতে পাওয়া যেতে পারে।
- শরীরের দুর্বলতা:
- আমাশার কারণে শরীর দুর্বল হতে পারে, কারণ শরীর তরল পদার্থ ও পুষ্টি হারিয়ে ফেলে।
- জ্বর:
- আমাশার কারণে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের জ্বর হতে পারে।
- দেহের পানি শূন্যতা (Dehydration):
- অতিরিক্ত ডায়রিয়া ও বমি হওয়ায় শরীরের পানি কমে যেতে পারে, যার ফলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে। এর ফলে শুকনো মুখ, তৃষ্ণা, দুর্বলতা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন হতে পারে।
প্রতিকার:
আমাশার চিকিৎসা মূলত এর কারণের ওপর নির্ভর করে। তবে কিছু সাধারণ প্রতিকার এবং যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে:
- অ্যান্টিবায়োটিক (Bacterial Dysentery):
- যদি আমাশার কারণ ব্যাকটেরিয়া হয় (যেমন শিগেলা বা স্যালমোনেলা), তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে পারেন। এটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক (Amoebic Dysentery):
- পরজীবী সংক্রমণ হলে চিকিৎসক অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধ দেবে, যেমন মেট্রোনিডাজল বা টিনিডাজল।
- পানি এবং লবণ (Oral Rehydration Solution):
- ডিহাইড্রেশন রোধে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও লবণ-মিশ্রিত পানি (ORS) খাওয়া উচিত, যা শরীরের তরল ও লবণ ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
- বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে ORS ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ।
- স্বাস্থ্যকর খাবার:
- আমাশার সময় হালকা, সহজে হজমযোগ্য খাবার খাওয়া উচিত। ফাস্টফুড, তেলযুক্ত বা মশলাদার খাবার পরিহার করা উচিত।
- স্যুপ, খিচুরি, ভাত, সেদ্ধ সবজি, ফল খাওয়া যেতে পারে।
- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
- খাবার বা পানীয় খাওয়ার আগে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।
- সুস্থ পানি এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার মাধ্যমে আমাশা প্রতিরোধ করা যায়।
- পচা বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
- জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসা:
- জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা অন্যান্য অনুরূপ ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, এটি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত।
- অ্যালোপ্যাথিক বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
- বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, তবে সেগুলি ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
- যদি পায়খানায় রক্ত বা মিউকাস দেখা যায়।
- যদি দীর্ঘ সময় ধরে ডায়রিয়া চলতে থাকে (২৪ ঘণ্টার বেশি)।
- যদি অতিরিক্ত জ্বর বা দুর্বলতা অনুভূত হয়।
- যদি বাচ্চাদের মধ্যে দ্রুত ডিহাইড্রেশন বা পানির অভাব দেখা দেয়।
আমাশা একটি সাধারণ রোগ হলেও এটি দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে সেরে যেতে পারে। তবে, দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।