আথ্রাইটিস (Arthritis) হল একটি রোগ যা শরীরের যৌথ (joint) অংশে প্রদাহ (inflammation) সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত হাড় এবং মাংসপেশীর সংযোগস্থলকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে ব্যথা, ফোলাভাব, এবং চলাফেরায় অসুবিধা হতে পারে। আথ্রাইটিসের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে, তবে সবচেয়ে সাধারণ দুটি প্রকার হলো:
- ওস্টিওআথ্রাইটিস (Osteoarthritis) – এটি একটি ঘর্ষণজনিত (degenerative) আথ্রাইটিস, যেখানে হাড়ের সংযোগস্থলের কার্টিলেজ (cartilage) ক্ষয় হয়ে যায়।
- রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis) – এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা ভুলক্রমে নিজের যৌথগুলোকে আক্রমণ করে।
আথ্রাইটিসের কারণ:
আথ্রাইটিসের কারণ বিভিন্ন হতে পারে এবং এটি প্রধানত বয়স, জীবনযাত্রার অভ্যাস, জেনেটিক প্রভাব এবং পরিবেশগত কারণে হতে পারে। এখানে কিছু কারণ দেওয়া হল:
- ওস্টিওআথ্রাইটিসের কারণ:
- বয়স: বয়স বাড়ানোর সাথে সাথে কার্টিলেজ ক্ষয় হতে থাকে, যা যৌথের মধ্যে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে।
- অতিরিক্ত শারীরিক চাপ: যৌথের উপর অতিরিক্ত চাপ বা কাজ, যেমন ভারী কাজ করা বা অতিরিক্ত হাঁটাহাঁটি, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- মোটা ওজন: অতিরিক্ত শরীরের ওজন যৌথের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
- আগের আঘাত: পূর্ববর্তী আঘাত বা চোট যৌথের মধ্যে পরিবর্তন বা ক্ষয় ঘটাতে পারে।
- জেনেটিক প্রভাব: কিছু ব্যক্তির মধ্যে এটি বংশগতভাবে প্রবণতা থাকতে পারে।
- রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের কারণ:
- অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া: এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিজের যৌথগুলোকে আক্রমণ করে।
- জেনেটিক: পরিবারের মধ্যে এটি থাকলে অন্য সদস্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
- হরমোন: মহিলাদের মধ্যে এটি পুরুষদের তুলনায় বেশি দেখা যায়, যা হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হতে পারে।
- পরিবেশগত কারণ: কিছু ভাইরাস বা জীবাণু সংক্রমণ রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের উদ্দীপক হতে পারে।
আথ্রাইটিসের লক্ষণ:
আথ্রাইটিসের লক্ষণ রোগের প্রকার এবং severity এর উপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- যৌথ ব্যথা: সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হল ব্যথা, বিশেষত চলাচল বা কাজ করার সময়।
- ফোলাভাব (Swelling): যৌথের চারপাশে ফোলাভাব দেখা দেয়।
- কঠোরতা (Stiffness): বিশেষ করে সকালের সময় বা দীর্ঘ সময় বসে থাকার পরে, যৌথগুলো শক্ত হয়ে যেতে পারে।
- লাল হওয়া এবং গরম অনুভব করা: প্রদাহের কারণে আক্রান্ত স্থানে গরম এবং লালচে হতে পারে।
- চলাচলে অসুবিধা: হালকা বা মাঝারি ব্যথাও চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যাক্সন পরিবর্তন: দীর্ঘমেয়াদী আথ্রাইটিসে, হাড়ের গঠন বা যৌথের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, যা হাত বা পায়ের আঙ্গুলের বিকৃতি সৃষ্টি করতে পারে।
আথ্রাইটিসের প্রতিকার:
আথ্রাইটিসের নিরাময়ের জন্য কোনও পুরোপুরি কার্যকর চিকিৎসা নেই, তবে সঠিক চিকিৎসা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং থেরাপি মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিছু কার্যকর প্রতিকার হল:
- ঔষধ (Medication):
- অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি (NSAIDs): যেমন আইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামল ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- স্টেরয়েড: প্রদাহ কমাতে কিছু ক্ষেত্রে স্টেরয়েড দেওয়া হতে পারে, যেমন প্রেডনিসলোন।
- ডিএমএআরডি (DMARDs): রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস এর জন্য, যেমন মিথোট্রেক্সেট।
- বায়োলজিকস: কিছু ক্ষেত্রে, যেমন রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের ক্ষেত্রে, বায়োলজিকস (যেমন TNF inhibitors) ব্যবহার করা হয়।
- অ্যানালজেসিকস: ব্যথা কমানোর জন্য সাধারণ ব্যথানাশক (যেমন প্যারাসিটামল) ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ফিজিওথেরাপি (Physical Therapy):
- শরীরচর্চা এবং থেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ইউজাল থেরাপি, স্ট্রেচিং বা ব্যায়াম করতে হবে যাতে যৌথের আন্দোলন ঠিক থাকে এবং শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- পালস ইলেকট্রিক থেরাপি, হট বা কোল্ড প্যাক ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- সার্জারি (Surgery):
- যদি আথ্রাইটিস গুরুতর হয়ে যায়, তখন যৌথ প্রতিস্থাপন (joint replacement) বা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে হাঁটু বা হিপ জয়েন্টের ক্ষেত্রে।
- লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
- ওজন কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন যৌথের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, বিশেষ করে অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি খাবার (যেমন তাজা ফল, সবজি, মাছ, শাক-সবজি)।
- স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং ধূমপান বন্ধ করা।
- গরম এবং ঠাণ্ডা সেঁক:
- গরম সেঁক এবং ঠাণ্ডা সেঁক আথ্রাইটিসের ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। গরম সেঁকটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যখন ঠাণ্ডা সেঁক প্রদাহ কমায়।
আথ্রাইটিস প্রতিরোধের উপায়:
- নিয়মিত শরীরচর্চা:
- হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাঁতার, বা যোগব্যায়াম নিয়মিত করা উচিত। এটি যৌথকে সচল রাখে এবং শক্তিশালী করে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ:
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন যৌথের উপর চাপ বাড়ায়, তাই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
- বিশ্রাম এবং সঠিক পজিশন:
- দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে না থাকার চেষ্টা করুন এবং সঠিক পজিশনে ঘুমান বা বসুন। পায়ের নিচে সঠিক সমর্থন প্রদান করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য:
- অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি খাবার, যেমন তাজা ফল, শাক-সবজি, মাছ ইত্যাদি খাদ্য গ্রহণ করুন।
আথ্রাইটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সঠিক সময় চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। যদি আথ্রাইটিসের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।