অপুষ্টি (Malnutrition) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলোর অভাবে ভোগে, যার ফলে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি খাদ্যের পুষ্টির অভাব, অতিরিক্ত পুষ্টি বা অপুষ্টির কারণে হতে পারে। অপুষ্টি শুধু প্রোটিন বা ক্যালোরির অভাবের কারণে নয়, বরং ভিটামিন, খনিজ বা অন্যান্য পুষ্টি উপাদানেরও অভাবে হতে পারে।
অপুষ্টি দুইটি প্রধান ধরণের হয়ে থাকে:
- প্রোটিন–কলোরি অপুষ্টি (Protein-energy malnutrition): যেখানে শরীর প্রয়োজনীয় ক্যালোরি বা প্রোটিন পাচ্ছে না।
- মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট অপুষ্টি (Micronutrient malnutrition): যেখানে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ (যেমন ভিটামিন A, ভিটামিন D, আয়রন, জিংক) পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না।
অপুষ্টির কারণ:
- অপর্যাপ্ত খাদ্য: বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দরিদ্রতা এবং খাদ্যের অভাব অপুষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অত্যধিক প্রক্রিয়াজাত, তেল ও চিনি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, যার ফলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাচ্ছে না।
- দীর্ঘস্থায়ী রোগ: যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, তীব্র ডায়রিয়া, বা টিউবারকুলোসিস, যা শরীর থেকে পুষ্টি শোষণকে বাধাগ্রস্ত করে।
- শিশুদের মধ্যে অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ: বিশেষ করে গর্ভাবস্থা এবং শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ শোষণ সমস্যা: ক্রনিক অন্ত্রের রোগ (যেমন সেলিয়াক ডিজিজ, ক্রোনস ডিজিজ) যা শরীরের পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
- মানসিক চাপ বা উদ্বেগ: মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ডিপ্রেশন, খাওয়ার অমনোযোগিতা বা অরুচি তৈরি করতে পারে, যা অপুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- অপর্যাপ্ত পুষ্টি শিক্ষা: খাদ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বা শিক্ষা না থাকা, যেমন কীভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া যায় বা কী কী পুষ্টি উপাদান দরকার—এটা অপুষ্টির কারণ হতে পারে।
- দূষিত পানি বা অপরিষ্কার পরিবেশ: পুষ্টির শোষণ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং এটি বিভিন্ন অন্ত্রের অসুখের সৃষ্টি করতে পারে, যা অপুষ্টির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অপুষ্টির লক্ষণ:
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ: শরীরের শক্তির অভাব এবং ক্লান্তি অনুভব করা।
- কম ওজন বা শরীরের বৃদ্ধি কম হওয়া: বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।
- চামড়া শুকিয়ে যাওয়া বা রুক্ষ হওয়া: ভিটামিন এবং খনিজের অভাবে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- পেশী দুর্বলতা: পেশী শিথিল বা দুর্বল হয়ে পড়া।
- অস্থিরতা বা মাথা ঘোরা: রক্তে গ্লুকোজের অভাবে বা সঠিক পুষ্টির অভাবে মাথা ঘোরা অনুভূতি হতে পারে।
- বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কষ্ট: অক্সিজেনের অভাব বা রক্তে আয়রনের কমতি হওয়া।
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া: সহজেই অসুখে আক্রান্ত হওয়া, ইনফেকশন বা ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হওয়া।
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেটের সমস্যা: অন্ত্রের স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হলে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- শারীরিক বৃদ্ধি থেমে যাওয়া: শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির কারণে উচ্চতা বা ওজন কম হতে পারে।
- শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা: অপুষ্টি শিশুর মানসিক এবং শারীরিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
অপুষ্টির প্রতিকার:
- পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ:
- ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাদ্য: ফল, শাকসবজি, ডাল, মাংস, মাছ, ডিম, দুধ ইত্যাদি।
- প্রোটিন: মাছ, মাংস, ডাল, ডিম, দুধ, পনির, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।
- কার্বোহাইড্রেট: ভাত, রুটি, আলু, বিভিন্ন শস্য, গম ইত্যাদি।
- বাল্যকালীন পুষ্টি: গর্ভবতী মায়েদের এবং নবজাতকদের জন্য যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি। গর্ভবতী মায়েরা বিশেষত আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন।
- পানি এবং জলশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন): পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করতে হবে।
- শিশুদের জন্য উপযুক্ত খাদ্য: ৬ মাসের পর একান্তভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর, পুষ্টিকর খাদ্য শুরু করতে হবে (যেমন সুষম ভাত, ডাল, তরকারি, ফল ইত্যাদি)।
- মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: যদি মানসিক সমস্যার কারণে অপুষ্টি হয়, তবে পরামর্শদাতা বা মনোবিদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
- স্বাস্থ্য শিক্ষা: সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর মনোযোগ দিতে পারে।
- চিকিৎসক পরামর্শ: দীর্ঘকাল ধরে অপুষ্টি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তারা উপযুক্ত সাপ্লিমেন্টস বা অন্যান্য চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারবেন।
অপুষ্টি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন:
- শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া।
- হৃদরোগ, কিডনি রোগ, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি।
অতএব, অপুষ্টির সমস্যা সমাধানের জন্য সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।