অন্ননালীর ক্যান্সার (Esophageal Cancer) হলো সেই ক্যান্সার যা অন্ননালী (esophagus), অর্থাৎ খাদ্যনালী বা খাদ্য গলানোর পথের কোষে ঘটে। এটি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- স্কোয়ামাস সেল ক্যান্সার (Squamous Cell Carcinoma): এটি সাধারণত অন্ননালীর উপরের অংশে ঘটে।
- এডিনোকারসিনোমা (Adenocarcinoma): এটি অন্ননালীর নিচের অংশে ঘটে এবং সাধারণত পাকস্থলী এবং অন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ স্থল হতে বেশি দেখা যায়।
কারণ:
অন্ননালীর ক্যান্সারের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে কিছু পরিচিত ঝুঁকি ফ্যাক্টর রয়েছে যা অন্ননালীর ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে:
- ধূমপান: তামাক ব্যবহারের কারণে অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
- অ্যালকোহল সেবন: অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি ধূমপানের সঙ্গে মিলিত হয়।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, অথবা ফল এবং সবজি কম খাওয়ার কারণে অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) বা অম্ল পিত্তের অভ্যন্তরীণ নিঃসরণ: দীর্ঘস্থায়ী এসিড রিফ্লাক্স (পেটের অ্যাসিডের অন্ননালীতে উঠে আসা) অন্ননালীর এডিনোকারসিনোমা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- বেরিয়েটের এসোফাগাস (Barrett’s Esophagus): দীর্ঘস্থায়ী এসিড রিফ্লাক্সের কারণে অন্ননালীর কোষের আকার এবং গঠন পরিবর্তিত হতে পারে, যা ক্যান্সারের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
- অতিরিক্ত ভারী খাবারের কারণে শ্বাসনালীতে চাপ পড়া: মোটা বা স্থূলতার কারণে অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- পূর্ববর্তী পরিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কেউ যদি অন্ননালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকে, তবে আপনারও এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
লক্ষণ:
অন্ননালীর ক্যান্সারের লক্ষণগুলি সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও, রোগটি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে:
- গলাতে খাবার আটকে যাওয়া: অন্ননালীতে ক্যান্সার হলে খাবার গিলতে সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে কঠিন বা শুকনো খাবার।
- ওজন কমে যাওয়া: অন্ননালীর ক্যান্সারের কারণে খাবার খাওয়ার সমস্যা হলে দ্রুত ওজন কমে যেতে পারে।
- থুতু বা খাবারের স্রাবের মধ্যে রক্ত আসা: অন্ননালীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে রক্তপাত হতে পারে, যা খাবারের স্রাবে উপস্থিত হতে পারে।
- বমি বা গা ব্যথা: গা-ব্যথা, বমি বা কোষ্ঠকাঠিন্য অনুভূতি হতে পারে।
- থাক্কা বা ব্যথা বুকের মধ্যে: অন্ননালীর ক্যান্সার শরীরে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে বুকের মধ্যে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসের সমস্যা: খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া বা অন্ননালীতে চাপ পড়া থেকে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া: দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা থাকার কারণে খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে।
প্রতিকার:
অন্ননালীর ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরণ, স্তর, এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুসারে। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি হলো:
- সার্জারি (অস্ত্রোপচার): ক্যান্সার আক্রান্ত অন্ননালীর অংশ অপসারণ করা হতে পারে, বা কখনও কখনও পুরো অন্ননালী অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে।
- কেমোথেরাপি: কেমোথেরাপি ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি সাধারণত সার্জারি অথবা রেডিয়েশন থেরাপির সাথে সমন্বিতভাবে করা হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি: রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি কেমোথেরাপি বা অস্ত্রোপচারের পরে দেওয়া হতে পারে।
- টার্গেটেড থেরাপি: এই থেরাপিতে ক্যান্সারের কোষগুলোর উপর সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমণ করা হয়, যা অন্যান্য কোষকে ক্ষতি না করে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
- ইমিউনোথেরাপি: এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে, যাতে শরীর নিজে থেকে ক্যান্সারের কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
- নিউট্রিশনাল সাপোর্ট: ক্যান্সারের চিকিৎসার সময় খাবার গিলতে সমস্যা হলে রোগীর পুষ্টি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
প্রতিরোধ:
অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে:
- ধূমপান এবং অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা: ধূমপান এবং অ্যালকোহল সেবন অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই এগুলো পরিহার করা উচিত।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: তাজা ফল, সবজি, এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা।
- অস্বাস্থ্যকর খাবার কম খাওয়া: অতিরিক্ত মাংস, ফ্যাট ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করা।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা, কারণ স্থূলতা অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- রিফ্লাক্স রোগের চিকিৎসা করা: যদি এসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা থাকে, তবে তা চিকিৎসা করা এবং বারবার বমি হওয়া বা গ্যাস অ্যাসিড রিফ্লাক্সের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।
উপসংহার:
অন্ননালীর ক্যান্সার দ্রুত শনাক্ত হলে এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়া হলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে, প্রাথমিক লক্ষণগুলো শনাক্ত করা এবং চিকিৎসককে পরামর্শ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা করা অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।